২০০৮ সালের দিকে শেওড়াপাড়া থেকে বনশ্রীতে কাজিনের বাসায় যেতাম দ্রুত গতির ইন্টারনেট ব্যবহার করতে। তখনো নিজের কম্পিউটার হয়নি। প্রতি সপ্তাহেই ২-৩ দিন বনশ্রীতে গিয়ে সারাদিন বিভিন্ন সাইট দেখতাম। বাংলাদেশে তখনও ফেসবুক জনপ্রিয় হয়ে উঠেনি। সামহোয়্যার ইন ব্লগ, টেকটিউনসসহ কয়েকটি ব্লগ পড়েই সময় কাটাতাম। হঠাৎ একদিন গুগলে বাংলায় সার্চ দিলাম। বাহ দারুণ তো! গুগলে বাংলাতেও সার্চ দেওয়া যায়। নতুন একটি বিষয়ের সঙ্গে পরিচিত হলাম। ‘ইন্টারনেটে আয়’ লিখে সার্চ দিলাম। শত শত সার্চ রেজাল্টের দেখা পেলাম। পড়া শুরু করলাম। পেয়ে গেলাম গুগল অ্যাডসেন্স নিয়ে ত্রিভুজ ভাইয়ের অসাধারণ কিছু টিউটোরিয়াল।
০১
গুগল অ্যাডসেন্স বা ফ্রিল্যান্সিং নিয়ে কোন ধারণাই ছিল না। টিউটোরিয়াল পড়া শুরু করলাম। কোন কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। কয়েক সপ্তাহ পর পড়ার পাশাপাশি কাজ করা শুরু করলাম। এসময় চিলড্রেন ভয়েস নিয়ে কাজ চলছিল। চিলড্রেন ভয়েসের নতুন সাইট দিয়ে অ্যাডসেন্সের জন্য আবেদন করে ফেললাম। কয়েকদিন পরেই অ্যাডসেন্সের বিজ্ঞাপন বসানোর অনুমতি পেলাম। ব্যাপক ভাবে বিজ্ঞাপন বসিয়ে বোকার মত নিজে নিজেই ক্লিক করা শুরু করলাম। কয়েকদিন পরেই দেখলাম ১১৭ ডলার হয়ে গেছে। তবে এর কয়েকদিন পরেই অ্যাকাউন্ট বন্ধ। নীতিমালা ভঙ্গের দায়ে ব্যান খেলাম গুগলের কাছে।
০২
চিলড্রেন ভয়েস নিয়ে কাজ করার সুবাদে ওয়ার্ডপ্রেস নিয়ে পড়াশোনা শুরু করলাম। সে সময় টেকটিউনসের নিয়মিত আলোচনার বিষয় ছিল ওয়ার্ডপ্রেস। সাথে জিনাতুল হাসান ভাইয়ের ব্লগ। অসাধারণ সব টিউটোরিয়াল। ওয়ার্ডপ্রেস দিয়েই তৈরি করা যায় কত রকমের ওয়েবসাইট। ভাবতেই কেমন যেন লাগছিল। আবারো পড়তে পড়তে কাজ শুরু করে দিলাম। সাদামাটা থিম ব্যবহার করে ওয়ার্ডপ্রেস দিয়ে চিলড্রেন ভয়েসের নতুন ওয়েবসাইট তৈরি করলাম। প্রতিদিন নতুন নতুন থিম, প্লাগিনের দেখা পেলাম। ব্যবহার করলাম। সাইটে আসতে শুরু করলো নতুনত্ব।
০৩
২০১০ সালের শুরুর দিকে যোগ দিলাম বাংলা নিউজে। ওয়েব বিভাগের পাশেই ছিল আমার ডেস্ক। এই বিভাগের শাওন ভাই, রাসেল ভাইদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ালাম। তারা কীভাবে কি কাজ করেন মাঝে মধ্যেই আলোচনা করলাম। নিজের লেখাগুলো নিজেই বাংলা নিউজে আপলোড করলাম। এখানেও নতুন নতুন বিষয়ের দেখা মিলতো। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ওয়ার্ডপ্রেসের কাজও বাড়তে থাকে। নিজের কাজের পাশাপাশি সহকর্মী, বন্ধু, বড় ভাইদের ওয়েবসাইট তৈরি করতে শুরু করি। বেশি কাজ না জানলেও যতটুকু পারতাম তারচেয়ে বেশি করার চেষ্টা করতাম। যা এখনো অব্যাহত আছে।
০৪
ওয়ার্ডপ্রেসের পাশাপাশি ওডেস্ক নিয়ে পড়াশোনা শুরু করলাম। সবাই নাকি এতো টাকা আয় করছে- আমি পারবো না কেন? টিউটোরিয়াল পড়লাম। অ্যাকাউন্ট করলাম। পরীক্ষা দিলাম। প্রোফাইল স্কোর ১০০% করলাম। ১০-১৫ কাজের জন্য আবেদন করলাম। কোন উত্তর পেলাম না। ফিরে গেলাম ওয়ার্ডপ্রেসেই। কাজের ব্যাপ্তি বাড়তে থাকলো। নানা ধরনের থিম দেখতে লাগলাম। নতুন নতুন প্রোগ্রামের সঙ্গে পরিচিত হলাম। কাজ করতে লাগলাম। ওয়ার্ডপ্রেস সত্যিই একটি আনন্দের কাজ। এসময় একটি সাইট দিয়ে আবার অ্যাডসেন্সের আবেদন করলাম। পেয়েও গেলাম। তবে ব্যবহার করা হয়নি।
০৫
বাংলা নিউজে কাজের ফাঁকে একদিন মাইক্রোওয়ার্কাসের খবর পেলাম। ছোট ছোট কাজ। একটি কাজ করে সর্বোচ্চ ০.৫ ডলার পেতাম। অনেকগুলো কাজ করে অ্যাকাউন্টে জমলো ১৮ ডলারের মত। অ্যালার্ট পে- অ্যাকউন্ট করে ব্যাংক এশিয়ার মাধ্যমে হাতে পেলাম ১৪০০ টাকা। ফ্রিল্যান্সিং করে প্রথম উপার্জন। সে কী উত্তেজনা! এই ১৪০০ টাকা নিয়ে ভাবতাম, দেশের অর্থনীতিতে আমারও অবদান রয়েছে।
০৬
ডিজিটাল মার্কেটিং নিয়ে কাজ করছি ২০১৪ সাল থেকে। ২০১৫ থেকে পুরোদমে চলছে ফেসবুক বিজ্ঞাপনের কাজ। কারণে অকারণে ফেসবুকেই থাকি ১২-১৬ ঘণ্টা। মাস কয়েক আগে কালের কণ্ঠে আল-আমিন কবিরের একটি সাক্ষাৎকার পড়লাম। অ্যামাজন অ্যাফিলিয়েট মার্কেটিং নিয়ে। একটু কৌতুহল জাগলো। তাদের ফেসবুক গ্রুপে যোগ দিলাম। নানা জনের পোস্ট পড়তে লাগলাম। ইংরেজি কিছু ব্লগ পড়লাম। আবারো চিলড্রেন ভয়েস দিয়ে অ্যামাজনে অ্যাফিলিয়েট মার্কেটিংয়ে আবেদন করলাম। কয়েকদিন পরেই উত্তর পেলাম পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে আমার রেফারেলের সূত্র ধরে কেউ যদি অ্যামাজন থেকে কোন পণ্য কিনে তাহলে আমার অ্যাকাউন্ট পুরোপুরি ভাবে অনুমোদন দেওয়া হবে। অবাক করার মত বিষয় হচ্ছে- কোন ধরণের পণ্য ক্রয়-বিক্রয় ছাড়াই আমার অ্যাকউন্টটি অনুমোদন পেয়ে গেল। ডোমেইন, হোস্টিং কিনে পুরোদমে শুরু করলাম কাজ। ৬-৭ হাজার টাকা খরচ করে বিভিন্ন পণ্যের রিভিউ করে সাইটে প্রকাশ করলাম। নিজের সাইটে এসইও করতে গিয়ে নতুন নতুন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হলাম। সারাদিন অফিস করে বাসায় এসে এভাবে কাজ করা সম্ভব নয়। কয়েকদিন কাজ করার পর থেমে গেলাম।
০৭
কাজ থেমে থাকলেও ভার্চুয়াল জগত থেমে নেই। ওয়েবসাইটে নিয়মিত ভিজিট করছেন বিশ্বের নানা দেশের মানুষ। আমার সাইটের রেফারেল দিয়ে অ্যামাজন থেকে কিনছেন নানা পণ্য সামগ্রী। আর অ্যামাজন তার আয়ের একটি অংশ শেয়ার করছে আমার সঙ্গে। জানুয়ারিতে ৮০ ডলার দিয়ে শুরু। অন্যরকম আনন্দ আবারো। অনলাইন থেকে আয় করা যায় তাহলে! আজ ডাচ-বাংলা ব্যাংকের বুথ থেকে পেওনিয়ার দিয়ে কয়েক মাসের ফ্রিল্যান্সিং আয়ের কিছু টাকা তুললাম। দেশের অর্থনীতিতে আবারো আমার অবদান বাড়লো। ভাবতেই কেমন যেন লাগছে।
এই আনন্দ থেকেই এই লেখার অবতারণা। হয়তো নতুন ফ্রিল্যান্সারদের কাজে লাগবে। তবে অভিজ্ঞতা থেকে মনে হচ্ছে ফ্রিল্যান্সিং করার আগে নিচের বিষয়গুলো মেনে চলা প্রয়োজন-
ক. চাকরির মত ফ্রিল্যান্সিংয়েও নিজেকে উৎসর্গ করতে হবে।
খ. চাইলেই ফ্রিল্যান্সিং সম্ভব নয়। প্রয়োজন অনেক পড়াশোনা ও সময়।
গ. চাকরি যদি ৮ ঘণ্টা করতেন ফ্রিল্যান্সিংয়ে সময় দিতে হবে তার চেয়ে বেশি।
ঘ. ৩৬৫ দিন সক্রিয় থাকতে হবে। কোন ছুটি নেই।
ঙ. হাল ছেড়ে দিলে হবে না। লেগে থাকতে হবে। ধৈর্য ধরতে হবে।
চ. বিনিয়োগ করতে হবে।
সুতরাং লেগে থাকুন সাফল্য আসবেই। স্বপ্নের পথে হাঁটলে স্বপ্ন পূরণ হতে আর দেরি নেই। তাই আপনিও যুক্ত হোন ফ্রিল্যান্সিংয়ে। আয় করুন ঘরে বসেই। ফ্রিল্যান্সিং হোক আপনার আয়ের উৎস।