বিগত অন্তত ছয় বছর ধরে অনলাইনে রয়েছে জঙ্গি বানানোর বিভিন্ন ফাঁদ। কিশোর বয়সীরা ‘ডেসপারেটলি’ সরকারের বা রাষ্ট্রের সমালোচনা করছে কিনা, তারা অন্যধর্মের প্রতি কী ধরনের মন্তব্য করছে, এসব দেখতে ফেসবুক বা অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গ্রুপ খুলে, সমসাময়িক ইস্যুতে নানা পোস্ট দিয়ে ওঁত পেতে বসে আছে ধর্মাশ্রয়ী উগ্র ও নিষিদ্ধ সংগঠনগুলো। ফাঁদে ফেলার পদ্ধতি জানতে চাইলে গবেষকরা বলেন, কে কী ধরনের মন্তব্য করছে তা দেখে তার প্রোফাইল যাচাই বাছাই করে তারপর শুরু হয় ব্যক্তিগত আলাপ। আর এই ফাঁদে ফেলতে শুরুতে স্টাডি সার্কেল এবং তারপর রয়েছে দ্বীনের দাওয়াত। একটা সমমনা গোষ্ঠী তৈরি হওয়ার পর সেখান থেকে বেছে অল্পসংখ্যক ব্যক্তিকে মূল গ্রুপ থেকে সরিয়ে অপারেশনের জন্য প্রস্তুত করানো হয়। একসঙ্গে ওঠবোস করলেও অপারেশনের জন্য যাদের বেছে নেওয়া হলো, তাদের কোনও কর্মকাণ্ডের বিষয়ে তখন আর ওই পুরো সার্কেলের কেউ কিছু জানতেও পারেন না। পুরো প্রক্রিয়াটার জন্য একজনের পেছনে সময় দিতে হয় কম করেও দেড় দুইবছর।
জঙ্গিবাদ নিয়ে গবেষণা করেন যারা তারা বলছেন, যারা এসব করছে তারা অনেক বেশি টেকনোলজিক্যালি এগিয়ে আছে। এদের নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে এই প্রক্রিয়াকে থামানো যাবে না। যারা এই ধরনের ধর্মের নামে ঘৃণা ছড়ানোর ফেসবুক পেজগুলো চালায় তারা‘সম্ভাব্য জঙ্গি’। এদের ধরে ধরে বিচারের মুখোমুখি না নিতে পারলে এটা কমবে না এবং ওদের আদর্শ ইন্টারনেটের সহায়তায় সাধারণ মানুষের দৃষ্টি সীমার মধ্যেই থাকবে।
বর্তমানে হিজবুত তাহরীরের কার্যক্রম নিষিদ্ধ হলেও তার আগেই তারা বেশকিছু প্রতিষ্ঠানে নিজেদের অবস্থান তৈরি করে নিয়েছে। তারা যখন ইন্টারনেটের মাধ্যমে এই কাজটি শুরু করে তখনও বাংলাদেশে সবার হাতে ইন্টারনেটের সুযোগ ছিল না। এই সুযোগে তারা কেবল সেই গোষ্ঠীটার কাছেই গিয়েছে, যেখানে জঙ্গি নিয়ে আলাপ করলে ‘থ্রিল’ অনুভব করবে এবং এই সমাজে রাজনৈতিকভাবে ভাল কিছু হচ্ছে না, সেই বক্তব্যের বিপরীতে কোনও বক্তব্য যার কানে পৌঁছানোর সুযোগ নেই।
কীভাবে কর্মী সংগ্রহ করা হয় প্রশ্নে এ প্রক্রিয়া থেকে বের হয়ে আসা একজন প্রবাসী বলেন, প্রথমে একটা গ্রুপে যোগ দেই আমি। একেবারেই সাদামাটা একটা ফেসবুক গ্রুপ যারা রক্তদান কর্মসূচিসহ নানা সামাজিক কর্মসূচি করতো। এরপর হঠাৎ হঠাৎ অনেকটা ধর্মীয় সংবেদনশীল বিষয়গুলো নিয়ে মতামত চেয়ে পোস্ট দেওয়া হয়। পোস্টগুলোতে তর্কবিতর্ক করার জন্যও নিজেদের মধ্যে অ্যাসাইন করা লোকজন থাকে। যিনি তর্কে নতুন লিপ্ত হচ্ছেন তাকে নানাভাবে কনভিন্স করার মতো একেকজন একেক জায়গা থেকে কমেন্ট করে একটা গ্রাউন্ড তৈরি করে। শুরুতে না বুঝলেও পরে বুঝতে পেরে তিনি তার সব যোগাযোগের রাস্তা পরিবর্তন করে ফেলেন।
জঙ্গিবাদের গবেষক নির্ঝর মজুমদার বলেন, নিজেদের মধ্যে কম গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আদান প্রদানের জন্য আরও একটি কৌশল কাজে লাগায় আইসিসের মত আন্তর্জাতিক জঙ্গিরা। তা হলো টুইটারে বিভিন্ন হ্যাশট্যাগ, যেগুলো খুঁজে বের করা বেশ পরিশ্রমসাপেক্ষ একটি কাজ। এতে করে যা হয়, তা হলো, প্রকাশ্যে থাকলেও তাদের তথ্য বা কথাবার্তা সেই নির্দিষ্ট হ্যাশট্যাগটি না জানলে খুঁজে বের করা সম্ভব হয় না। এই হ্যাশট্যাগগুলো বিভিন্ন সংখ্যা এবং বর্ণের সমন্বয়ে গঠিত হওয়ার কারণে, অন্য কোনও উৎস থেকে না জানলে খুঁজে বের করা প্রায় অসম্ভব একটি কাজ।
করণীয় বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ফেসবুকে যখন কোনও নির্দিষ্ট সেক্টরকে ধরে প্রচারণা চালাবেন সেটা আরও অন্য অনেকের কাছে যাচ্ছে। ভিন্ন ব্যাকগ্রাউন্ডের সদস্যরা তেমন করেই আগ্রহী হচ্ছে। প্রথম করণীয়, ফেসবুকে কোন জিনিসটা আইনের বাইরে বা আওতায় তা ডিফাইন করা কঠিন। এটাকে আইন দিয়ে কিছু করতে পারবেন না। মনে রাখতে হবে, ওরা যা করে সেটা ধর্মীয় প্রচারণার কথা বলে করে। প্রকাশ্যে তারা কখনোই কিছু বলবে না। তবে মাঝে মাধেই রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত নিয়ে হেটস্পিচ ছড়ানোর চেষ্টা করে। সেটাকেই ধরে এদের নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। তিনি আরও বলেন, সব পেজ বন্ধ করলেও সম্ভব না। বন্ধ করলে আরেকটা খুলে যাবে। এগুলো বাংলাদেশের ভেতরে বসে বসে কেউ না কেউ চালায়। তাদের চিহ্নিত করে বিচারের মুখোমুখি করে উদাহরণ সৃষ্টি করতে হবে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল আব্দুর রশিদ বলেন, যারা ব্রেন ওয়াশ করতে চায় তারা কয়েকটি বিষয়ে নজর দিয়ে থাকে। যে কিশোর হাইস্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শুরুতে আছে তার মগজ ধোলাই সহজ। কিংবা এই বয়সী যারা একেবারেই কখনও ধর্মচর্চার মধ্যে ছিলো না তাদের মধ্যে ভীতি ঢোকানো সহজ। তারা তাদেরকেই টার্গেট করছে। মাদ্রাসা ছেড়ে উচ্চবিত্তের দিকে মনোযোগ দিয়েছে এমন একেবারেই না। প্রত্যেকটা জায়গার জন্যই তাদের টার্গেট রয়েছে। আর অনলাইনের মাধ্যমে তারা এদের কাছে সহজে পৌঁছাতে পারছে। ফলে শক্ত মনিটরিং এর মাধ্যমে এই গোষ্ঠীকে নিয়ন্ত্রণে নিতে হবে।
info :: বাংলা ট্রিবিউন