News Bangla 24 BD | ঈদ হোক মানবতার কল্যাণে
News Head

কামরুল আলম::

জনৈক মধ্যবিত্ত পরিচিত ব্যক্তি ঈদের দু’দিন আগে আমার নিকট হাজার পাঁচেক টাকা ধার চাইলেন। ঈদের সময় টাকা ধার নিয়ে কী করবেন জানতে চাইলে তিনি বললেন, ‘একটা ছোট ছাগল কিনবো’। তিনি ঋণ করে কোরবানি দিতে যাচ্ছেন দেখে তাকে স্মরণ করিয়ে দিলাম, ‘ঋণ করে কোরবানি দেওয়ার বিধান তো শরিয়তে নেই। বরং আপনার ওপর কোরবানি দেওয়া ওয়াজিব কি না তা আগে ভালো করে জেনে নিন, তারপর টাকা ধার করুন। ধারের টাকায় কোরবানি দেওয়া ঠিক হবে না।’ ভদ্রলোক নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, ‘ভাই কোরবানির মাসলা-মাসায়েল কমবেশি আমিও জানি। কিন্তু বাচ্চাকাচ্চাদের নিয়ে সংসার, ঈদের দিন গোশত খেতে না পারলে মনে হবে পায়ের নিচ থেকে সমস্ত মাটিই যেন সরে গেছে। তাই ঋণ করে হলেও কোরবানি দিচ্ছি, আল্লাহ চাইলে এ ঋণ অবশ্যই শোধ করার সামর্থ্য আসবে।’

আমাদের দেশে ঈদুল আদ্বহা প্রতিবছর আসে ত্যাগের নজরানা পেশ করতে। কে কতো বড়ো গরু কোরবানি দিবেন রীতিমতো তার একটি মহড়া তৈরি হয়ে যায় ঈদের সময়। এই বিশাল আকৃতির গরুগুলো আবার গোশত আকারে কোরবানিদাতাদের ফ্রিজের ভিতরেই জমা থাকে। ত্যাগের নজরানা কেবল মুখে মুখে, আসলেই কি গরু ত্যাগ (কোরবানি) করা হয়? যদি হতো তাহলে অভাবগ্রস্তদের নিশ্চয়ই ঋণ করে কোরবানি দেওয়ার প্রয়োজন পড়তো না। গেল ঈদের দিন বিকেলে আমার এক আত্মীয়ের বাসায় গিয়ে দেখি তাদের বাড়িতে বাড়িওয়ালা দু’টো গরু কোরবানি দিয়েছেন। বাড়ির গেট ভেতর থেকে আটকানো। গেটের বাইরে শ’খানেক গরিব লোকজন দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে। আমি কোনমতে নিজের উপস্থিতি জানান দিতে পারলে গেট খোলা হলো। গেট খুলতেই দেখি বাইরে অপেক্ষমান গরিব লোকজন হইহুল্লোড় করে ঢুকতে চাইছে। একজন লোক লাঠি হাতে তাদের পিঠিয়ে বাড়ির বাইরে বের করে দিলেন। গালাগালিও করলেন গরিবদের। আমি ভাবছিলাম, গরু কাটা বাকি আছে বোধহয়, কিন্তু ভেতরের দৃশ্য ভিন্ন। গরুর গোশত ফ্রিজে ঢুকে গেছে ইতোমধ্যে। বাড়িওয়ালার সন্তানেরা সেই গরুর কলিজি দিয়ে চাউলের রুটি খাচ্ছে আর ঢেকুর তুলছে। অথচ বাইরে অপেক্ষমান লোকগুলো দুপুরের ভাতই খায়নি! এই যদি হয় কোরবানি, তাহলে এমন কোরবানি দেওয়ার চেয়ে আসলে না দেওয়াই ভালো হবে। গরিব লোকজনের সঙ্গে ফাজলামি না করে নিজের টাকা দিয়ে নিজে যে কোন সময় গরু জবাই করে খাওয়া যাবে। ঈদের দিন গরিবের হক নিজে ভক্ষণ করার কোন মানে হয় না।

কোরবানির গোশত নিজে খাওয়ার বিধান আছে ইসলামে। তবে উত্তম পদ্ধতি হলো, তিনভাগের একভাগ গোশত গরিব-মিসকিনদের মধ্যে বিতরণ করা, একভাগ নিজের আত্মীয় স্বজনকে দেওয়া। তিনভাগের শেষ একভাগ নিজে খাওয়ার জন্য রাখার বিধান। কিন্তু সত্তর আশি হাজার টাকা দিয়ে গরু কিনে তার তিনভাগের দুইভাগ বিতরণ করতে যে ধরনের মন মানসিকতা থাকার কথা তা আমাদের অনেকের মধ্যেই নেই। আমরা ত্যাগ করতে জানি, তবে সেটার পরিমাণ খুবই কম। তিন হাজার টাকার গোশত না হয় বিতরণ করেই দিলাম, তাই বলে ত্রিশ হাজার টাকা? ত্যাগ আর কাকে বলে, সাধে কী কবি বলেছেন- ভোগে সুখ নেই, ত্যাগেই প্রকৃত সুখ! যাকাতের শাড়ি লুঙ্গি বিতরণের লাইনে দাঁড়িয়ে যাকাতগ্রহীতাদের মৃত্যুর খবরও আমাদের দেশে তোলপাড় সৃষ্টি করতে পারেনি, কোরবানির ঈদের গোশত সংগ্রহে গিয়ে এমন ঘটনা ঘটে গেলে তা নিন্দনীয় হবে না নিশ্চয়ই। আমরা এসব সয়ে যেতে পারি, আমাদের এ ক্ষেত্রে ধৈর্য্য ধারণের ক্ষমতা অনেক বেশি।

পরিশেষে কোরবানিদাতাদের প্রতি অনুরোধ, ত্যাগের নজরানা পেশে একটু হলেও এগিয়ে আসুন। স্মরণ করুন নবি হযরত ইবরাহিম (আ.) এর কথা। বৃদ্ধ বয়সে পাওয়া কিশোর সন্তান ইসমাঈল (আ.)-কে ত্যাগ করার (কোরবানি) নির্দেশ পেয়ে তিনি দ্বিধা করেননি। নিজের প্রাণাধিক প্রিয় পুত্রের গলায় ছুরি বসিয়ে দিয়ে তিনি আল্লাহর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। আল্লাহ রাব্বুল আ’লামিন তাঁর ওপর সন্তুষ্ট পুত্রে পরিবর্তে একটি পশু সেখানে জবেহ করার বিধান তৈরি করে দেন। সেই বিধানের অনুসরণই আমাদের আজকে কোরবানি। আমরা হযরত ইবারহিম (আ.) এর সুন্নত পালন করতেই এ কোরবানির আয়োজন করি। অথচ নিজেরা ভোগবিলাসে মত্ত হলেও পাড়া-প্রতিবেশিদের অনেকেই না খেয়ে থাকছে সেদিকে নজর পর্যন্ত দিতে পারি না। ঈদ আসে ঈদ যায়, পরিবর্তন হয় না কেবল আমাদের মানসিক অবস্থা। তৈরি হয় না আমাদের হৃদয়ে মানবিক কোন মূল্যবোধ। আমরা পশু কোরবানি করি বটে, তবে নিজের পাশবিকতাকে কোরবানি করতে ব্যর্থ হই। তাই ঈদুল আদ্বহায় আসুন শপথ গ্রহণ করি, ধনী-গরিব ব্যবধান ঘুচিয়ে দিয়ে সবাই মিলে মিশে আনন্দে উদযাপন করবো ঈদ। ঈদের আনন্দ কেবল বড়োলোক-টাকাওয়ালাদের ফ্রিজের ভেতরে বন্দী না থেকে বরং তা ছড়িয়ে পড়বে গরিবের ঘরে ঘরে। ত্যাগের মহিমায় আনন্দিত হবে কোরবানিদাতাদের মন। কারণ ভোগে নয়, ত্যাগেই প্রকৃত সুখ। মানবতার কল্যাণে এ সুখ আমাদের অর্জন করতেই হবে।

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ