রায়হান আহমেদ তপাদার : প্রবাসীদের দুঃখ কষ্টে ভরা! রেকর্ড পরিমাণ রেমিট্যান্স ::
মা-বাবা,স্ত্রী-সন্তান ও নিকটাত্মীয়দের রেখে বহুদূরে বিদেশের মাটিতে কর্মরত প্রবাসী শ্রমিকের তিলে তিলে অর্জিত অর্থ দিয়ে গড়ে ওঠা রেমিটেন্স আয় বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি।দারিদ্র বিমোচন থেকে শুরু করে বাজেট তৈরি পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রে এই রেমিটেন্স প্রধান নিয়ামকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়।পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ৯৪ লাখ বাংলাদেশী অভিবাসীদের পাঠানো অর্থের পরিমাণ সর্বোচ্চ ১৫ বিলিয়ন ডলারের নতুন মাইলফলক স্পর্শ করেছে।
বাংলাদেশী মুদ্রায় হিসেব করলে যার পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় সোয়া লাখ কোটি টাকা।২০১৫ অর্থ-বছরে অভিবাসী শ্রমিকদের পাঠানো অর্থের হিসাব থেকে এই রেকর্ড পরিমাণ রেমিটেন্স আয়ের চিত্র জানা যায়।প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী,৯৪ লাখ বাংলাদেশী অভিবাসী তাদের কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে অর্জিত আয় থেকে ২০১৫ অর্থবছরে ১৫.৩১ বিলিয়ন ডলার বাংলাদেশে পাঠিয়েছে। বাংলাদেশী মূদ্রায় হিসাব করলে যার পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ১ লাখ ২২ হাজার ৪৮০ কোটি টাকা।বাংলাদেশের ইতিহাসে এ যাবত এটাই সর্বোচ্চ রেমিটেন্স আয়ের রেকর্ড।অভিবাসী শ্রমিকদের বিষয়ে কর্মরত সরকারী সংস্থা বিএমইটি এর দেয়া ২০১৫’র জুন পরবর্তী এক জরিপে বলা হয়,সংযুক্ত আরব আমিরাত বা আবুধাবি বাংলাদেশ থেকে নারী শ্রমিক রপ্তানির ক্ষেত্রে এক নম্বর অবস্থানে রয়েছে।বিএমইটির ওই জরিপ অনুযায়ী,বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশী মোট নারী অভিবাসীদের ২৭ শতাংশই শুধুমাত্র আবুধাবিতে কর্মরত রয়েছেন।প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রনালয় থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী,আবুধাবির পর সর্বোচ্চ সংখ্যক বাংলাদেশী নারী শ্রমিক রয়েছেন লেবাননে।বর্তমানে বিদেশে কর্মরত বাংলাদশী নারী অভিবাসীদের ২৪.৩ শতাংশই রয়েছেন শুধুমাত্র লেবাননে।যদিও সবমিলিয়ে দেশটিতে বিদেশে কর্মরত মোট বাংলাদেশী অভিবাসীদের মাত্র ১.৩ শতাংশ অবস্থান করছেন।
সবশেষ জরিপ অনুযায়ী,লেবাননে প্রায় ৯৭ হাজার বাংলাদেশী নারী শ্রমিক কর্মরত রয়েছেন।তবে,নারী অভিবাসী তুলনামূলকভাবে কম থাকলেও সার্বিক হিসাবে সর্বোচ্চ সংখ্যক বাংলাদেশী অভিবাসী শ্রমিক রয়েছেন সৌদি আরবে।মোট অভিবাসীদের ২৮.২ শতাংশই কাজ করছেন শুধুমাত্র সৌদিতে।২০১৫ সালের জুন মাসের শেষে বিএমইটির দেয়া এক হিসেবে বলা হয়, বর্তমানে ২৬ লাখেরও বেশি বাংলাদেশী অভিবাসী সৌদিআরবে কর্মরত রয়েছেন।আর বাংলাদেশ ব্যাংকের দেয়া হিসাব অনুযায়ী,শুধুমাত্র সৌদি আরব থেকে ২০১৪ সালে বাংলাদেশের রেমিটেন্স আয় হয়েছে ৩.১২ বিলিয়ন ডলার।বাংলাদেশী মুদ্রায় যার পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ২৪ হাজার ৯৬০ কোটি টাকা।আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে কেবল জনশক্তি পাঠানোতেই দায়িত্ব শেষ নয়,প্রয়োজন সার্বক্ষণিক মনিটর।শ্রমশক্তির মর্যাদা,স্বার্থরক্ষা, নিরাপত্তা,কমিউনিটির সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিতের জন্য তদারকি।এ ছাড়া অপরিকল্পিতভাবে প্রশিক্ষণ ছাড়াই শ্রমশক্তি রপ্তানির বিষয়টিও জটিলতা বাড়ায়।এ কথা অনস্বীকার্য যে,দেশের কর্মক্ষম মানুষের আবেগ আছে। তাদের আবেগকে কাজে লাগানো সরকারি দায়িত্ব। এ ক্ষেত্রে সরকারি ব্যাপক উদ্যোগ দরকার।প্রয়োজন অঞ্চলভিত্তিক প্রশিক্ষণ কর্মসূচি হাতে নেয়া।এগুলো করা হচ্ছে না।ফলে আবেগী কর্মক্ষম যুবকগুলো দালালদের আশ্রয় নিতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন।
এসব ক্ষেত্রে বেশির ভাগ সময়ই তাঁরা সর্বস্ব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েন।সাগর বা আকাশপথে বিদেশ যাওয়ার সময় দুর্যোগের মুখোমুখি হন।কখনো সাগরে দিনের পর দিন ভেসে থাকতে হয়।পানি ও খাবারের অভাবে দেহাবসান ঘটে।কখনো বিদেশের কারাগারে আপনজনের সঙ্গে যোগাযোগহীন দিন কাটাতে হয়।ভাগ্য একটু সুপ্রসন্ন হলে লুকিয়ে হয়তো দু-একটা কাজ জোগাড় করতে সক্ষমও হন।তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এই ধারা দুর্বল।কষ্টসহিষ্ণু মানবিকতারও দেখা মেলে না সে সময়।অথচ প্রশিক্ষণ, পর্যাপ্ত তথ্য,সঠিক প্রস্তুতি ও প্রয়োজনীয় কাগজ নিয়ে বিদেশ গেলে সফলতার সম্ভাবনা বেশি।দরকার ভাষাগত দক্ষতাও।যদিও প্রশিক্ষণের মধ্যেই তা অন্তর্ভুক্ত অভিবাসন প্রত্যাশীদের অবর্ণনীয় দুর্দশার চিত্র প্রায় প্রতিদিন গণমাধ্যমে প্রকাশ পাচ্ছে।মানুষ কতোটা মরিয়া হয়ে মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে এই পথ বেছে নিচ্ছে সেটা সহজেই বোধগম্য। রাজনৈতিক সঙ্কটকালে এইরূপ বেপরোয়া অভিবাসন আমাদের চোখে অস্বাভাবিক ঠেকছে।কিন্তু প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই অভিবাসন একটি স্বাভাবিক ও নৈমিত্তিক প্রক্রিয়া হিসেবেই চালু আছে।আজকের বাঙালি জাতিও গড়ে উঠেছে বিভিন্ন জনজাতির ক্রমাগত অভিবাসন ও সঙ্করায়ণের মাধ্যমে।বর্তমানে অভিবাসন প্রক্রিয়া এতো ব্যাপকভাবে বাড়েছে যে,আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইএমও)ওয়ার্ল্ড মাইগ্রেশন রিপোর্ট ২০১৫’শীর্ষক প্রতিবেদন বলছে, সমগ্র বিশ্বে প্রতি সপ্তাহে ৩০ লাখ মানুষ শহরে আসছে।রিপোর্টে আরও বলা হচ্ছে, বর্তমানে এক দেশ থেকে অন্য দেশে অভিবাসী মানুষ ২৩ কোটি ২০ লাখ;আর বিভিন্ন দেশে অভ্যন্তরীণ অভিবাসী মানুষের সংখ্যা ৭৪ কোটি।
বিশেষজ্ঞদের মতে,বর্তমানে বিশ্বে প্রতি ৩৫ জন মানুষের মধ্যে ১ জন অভিবাসী।বলাবাহুল্য,বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে-ছিটিয়া থাকা বিপুল সংখ্যক অভিবাসীদের সমস্যা এবং বিরূপ বাস্তবতা বিশ্বসমাজের বড় এক উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে বিশ্বের ১৬০টি দেশে বাংলাদেশের প্রায় ১ কোটি মানুষ কর্মরত আছেন এবং প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৫ লাখ কর্মীর বৈদেশিক কর্মসংস্থান হচ্ছে।কেবল তাই নয়,বিশ্বব্যাংকের হিসেবে, বিশ্বে প্রবাসী-আয়ের শীর্ষ ১০টি দেশের মধ্যে বাংলা দেশের অবস্থান এখন সপ্তম।দেশের অর্থনৈতিক ভিত্তি সুদৃঢ় করার প্রত্যয়ে অভিবাসী কর্মীরা যে অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন, তাদের অবদানকে কী মূল্যায়ন করা হচ্ছে? অভিবাসীদের কল্যাণে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের আত্মশ্লাঘার পাশাপাশি আমাদের আত্মসমালোচনাও জরুরি হয়ে উঠছে।বাংলাদেশ সরকার জনশক্তি রফতানি খাতে স্বচ্ছতা এবংজবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠার কথা বারবার বললেও বাস্তবতা হচ্ছে প্রতি বছর-ই হাজার হাজার শ্রমিক প্রতারিত হয়ে দেশে ফিরে আসেন।ঠিক কি পরিমাণ অভিবাসী শ্রমিক এমন সমস্যার শিকার হন সেটার সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও অভিবাসী শ্রমিকদের সমস্যা নিয়ে কর্মরত বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গুলোর মতে,প্রতি বছর এমন প্রতারণার শিকার হয়ে দেশে ফিরছে অন্তত ৫০ হাজার শ্রমিক।এই বাস্তবতায় পরভূমে অর্থ উপার্জনে গিয়ে আমাদের নাগরিকেরা প্রতারিত হচ্ছে কি না,অধিকার বঞ্চিত হচ্ছে কি না সেই দিকেও সতর্ক নজর দেয়া আবশ্যক।বিশ্ব অর্থনীতির একটি বিরাট অংশ নির্ভর করে অভিবাসীদের শ্রমের উপরে।বাংলাদেশের বাড়তি জনসংখ্যার হিসেবে শ্রম অভিবাসন দেশের জন্য একটি সম্ভাবনাময় খাত।ব্যাপক এ সম্ভাবনা কাজে লাগাতে সরকারের দায়িত্বশীলদের তৎপরতার ঘাটতি শুরু থেকেই।দেশের বৃহৎ ও সম্ভাবনাময় এ খাতটির দিকে সরকারের মনোযোগ দেয়া জরুরি।এর যথাযথ ব্যবহারে দেশের সমৃদ্ধি সম্ভব।এক্ষেত্রে সময়োপযোগী সরকারি উদ্যোগ ও কার্যকর শ্রমব্যবস্থাপনা প্রত্যাশিত।