ইউটিউবে কর্মরত এক বাংলাদেশি প্রতিভাবান
প্রযুক্তির ব্যবহারে দেশ এগিয়ে চলেছে। বলা হয়, এখন ইন্টারনেট যুগে বাংলাদেশ। সামনে বিশাল সম্ভাবনার দিগন্ত। এই সম্ভাবনায় প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে চলেছেন দেশের অনেক তরুণ। এই তরুণরা বহির্বিশ্বে নিজ পারদর্শিতায় বাংলাদেশকেই ঊর্ধ্বে তুলে ধরছেন। ইউটিউব, গুগল ও আন্তর্জাতিক অনেক মাধ্যমে তরুণদের সাফল্যগাঁথা মুগ্ধ করে আমাদের। তেমনি এক তরুণের কথা শোনাবো আজ।
মৌলভীবাজারের প্রতিভাবান এই তরুণের নাম মিনহাজ হুসাইন। মিনহাজ এখন ইউটিউবে চাকরি করছেন। YouTube –এর নতুন অফিস Kings Cross –এ কর্মরত রয়েছেন।
বাংলাদেশের মাঝারি মানের একজন ছাত্র গ্রামের স্কুল থেকে এস এস সি পাশ করে (জিপিএ ৩.৪০, বিজ্ঞান বিভাগ ২০০৪ সাল) নিজ প্রতিভা গুণে এখন লন্ডনে ইউটিউবের মতো প্রতিষ্ঠানে চাকরিরত। যা চমকে দেওয়ার মতোই ঘটনা।
তার অন্যান্য পড়াশোনা সম্পর্কে তরুণ মিনহাজ নিজেই বললেন, ‘২০০৬ সালে লংলা আধুনিক ডিগ্রি কলেজ থেকে আইএসসি (জিপিএ ৩.৮০), এর পর IELTS দিয়ে ভর্তি হয়ে হলাম Brit College London-এ Higher National Diploma in Computer Science বিষয় নিয়ে। এরপর বার্মিংহাম সিটি ইউনিভার্সিটিতে বিএসসি শেষ করলাম Computer Science and Network Security নিয়ে।
তিনি জানান, ছোটবেলা থেকেই ‘ইলেক্ট্রনিক্স’ এর প্রতি তীব্র আগ্রহ ছিল তার। বাবার শাসনে বিপত্তি হলেও সাপোর্ট ছিল মায়ের।
প্রাসঙ্গিক আরো নানা বিষয়ে আলাপ হলো মিনহাজ হুসাইন এর সঙ্গে।আলাপকালে খোলাখুলি অনেক কথাই জানালেন আলোকিত এই তরুণ। রাইজিংবিডির পাঠকদের জন্য তা এখানে তুলে ধরা হলো :
ইউটিউবে কীভাবে, কেমন করে শুরু?
মিনহাজ হুসাইন : এমএসসি সেকেন্ড ইয়ারে থাকতে এক সেমিনারে পরিচয় হল গুগল ইউকে লি. এর এক প্রোডাক্ট ম্যানেজারের সাথে। প্রতি বছর সামারে ‘গুগল ইউকে’ যুক্তরাজ্যে ইন্টার্ন প্রোগ্রাম অফার করে, মেয়াদ ৬ মাস। আবেদন করি ইন্টার্ন প্রোগ্রামের জন্যে, সে ভদ্রলোকের রেফারেন্স দিয়ে। ২ সপ্তাহ পর ইমেইলে আমাদের ইন্টারভিউ’র তারিখ জানানো হল। ইন্টারভিউ নেওয়া হবে অনলাইনে। ২ জন গুগল অফিসিয়াল, একজন লেডি ও একজন ভদ্রলোক নিজেদের পরিচয় পর্ব শেষে আমার সারা জীবনের অর্জিত জ্ঞানের চরম পরীক্ষা নেওয়া শুরু করলেন, এমন সব প্রশ্ন করছেন যা আমার গুগলে কাজ করার শখ তিলে তিলে মিটিয়ে দিচ্ছে, আমি তো শিউর আমার এখানেই শেষ। তবে সেটা মনে মনে, তাদের বুঝতে দেইনি। এমন সব প্রশ্ন শুনে আমি ভেবে পাইনা গুগলের সাথে এসবের কি সম্পর্ক? সব শেষের প্রশ্ন ছিল ‘টেল মি আ জোক’। কি জোক বলেছিলাম তা আজ আর মনে নেই, তবে ওদের মুখে কিঞ্চিৎ হাসি দেখতে পেয়েছিলাম, এটুকু বেশ মনে আছে। ইন্টারভিউ শেষে, আমাকে বলা হল নেক্সট ৭ বিজনেস ডে’র ভেতর সিদ্ধান্ত জানানো হবে। ঠিক এক সপ্তাহ পর একটা মেইল এলো। আমাকে সিলেক্ট করা হয়েছে, গুগল অফিসে গিয়ে হাজিরা দিতে হবে। গেলাম, আমার মত যারা সিলেক্ট হয়েছে সবাইকে এক একটা গ্রুপে ভাগ করে টাস্ক দেওয়া হলো। অর্থাৎ কয়েকটা টিম করা হলো। ৬ মাস পর সকল টিমের ফাইনাল পরীক্ষা হবে এবং ১০ টা টিমের মধ্যে অনলি একটা টিমকে গুগলে পার্মানেন্ট জব দেওয়া হবে।
ইউটিউবে চাকরি নিয়ে বলুন :
মিনহাজ হুসাইন : আমাকে দেওয়া হল YouTube UK & Ireland এর কপিরাইট/ DMCA ডিপার্টমেন্ট। কারণ আমার টাস্ক/ Exam রেজাল্ট এর ভিত্তিতে ইউটিউবই আমার জন্যে বেটার। ২০১৩ থেকে আজও আছি। এখন আমরা চলে এসেছি ইউটিউব এর নতুন অফিস Kings Cross –এ। যার নাম YouTube Space London. এর পাশেই গড়ে উঠছে সুবিশাল ভবন, আগামীতে এখানেই চলে আসবে Google HQ ।
কি ধরনের কাজ করতে হয় আপনাকে?
মিনহাজ হুসাইন : বিশাল প্ল্যাটফর্ম ইউটিউব, তবে এর হেড কোয়ার্টার ক্যালিফোর্নিয়ার মতো সকল ক্ষমতা আমাদের হাতে নেই।
আমরা যারা DMCA (Digital Millennium Copyright Act) অর্থাৎ কপিরাইট এর কেইসগুলো দেখি, আমাদের হাতে অন্য কোন ক্ষমতা নেই। এই যেমন কারো চ্যানেল সাসপেন্ড হলে সেটা Reinstate করা, বা কেউ কোন চ্যানেল রিপোর্ট করলে সেটা ডাউন করার এখতিয়ার আমাদের নেই। তার জন্য আছে আমাদের Enforcement Department.
দেশে জনপ্রিয় সামাজিক মাধ্যমের একটি ইউটিউব। অনেকের ধারণা ইউটিউবের মাধ্যমে অর্থ উপার্জন সহজ। আপনি কী বলেন?
মিনহাজ হুসাইন : ইউটিউব নিঃসন্দেহে জনপ্রিয় এবং নিয়মিত ডলার আয়ের একটি চমৎকার উপায়। পৃথিবীব্যাপী প্রতিনিয়ত এর পরিধি বেড়েই চলেছে, পাশাপাশি এর অপব্যবহার ও অন্যান্য কারণে এর রুলস রেগুলেশনও পরিবর্তিত হয়। আমার কাজের কিছু বিষয় পরিষ্কার করে বললে ধারণা পাবেন।
১। কেউ আপনার ভিডিও কপি করে আপলোড দিয়েছে, আপনি সেটা আমাদের কাছে রিপোর্ট করলেন যথাযথভাবে। আমরা আপনার অভিযোগ যাচাই করে দেখবো। সত্যতা পেলে আমরা সেই অপরাধীকে একটা নোটিশ দিয়ে ঐ ভিডিওটি রিমুভ করে দেবো, আবার আমরা তাকে একটা চান্স দেবো যেন সে যদি প্রমাণ করতে পারে সে ভিডিওটি কপি করেনি, সে ক্ষেত্রে ১০ দিনের সময়সীমা আমরা বেঁধে দেই।
২। কেউ Take Down Notice দিয়ে একটা ভিডিও রিমুভ করলো, অন্য পার্টি সে সিদ্ধান্ত না মেনে আমাদের কাছে আপিল করল, এক্ষেত্রে আমাদের অনেক সূক্ষ্মভাবে এই অভিযোগ যাচাই করে সিদ্ধান্তে উপনীত হতে হয়। এই রকম কাজের জন্যে আমাদের Automatic System (Bot/ Robot) এর সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারি না।
৩। কারো চ্যানেলে একটা ভিডিও আপলোড করার সাথে সাথে আমাদের Automatic System (Bot/ Robot) তা স্ক্যান করে স্ক্যান রেজাল্ট এর ভিত্তিতে সে নিজেই অ্যাকশন নিয়ে নেয়। তারপরও আমাদের সেই সিদ্ধান্তগুলোকে আবার যাচাই করতে হয়, আমরা চাইনা একটা সামান্য ত্রুটির কারণে কারো কষ্টের সৃষ্ট ইউটিউব চ্যানেল ক্ষতিগ্রস্ত হোক।
৪। ‘গুগল ইউকে’তে যেহেতু জনবল একটু কম, সেখানে আমরা নিজেদের ডিউটির ফাঁকে সমস্ত সাইটকে র্যান্ডমভাবে স্ক্যান করি, খুঁজে বের করি Offensive Content অর্থাৎ Hate Speech, Sexually Suggestive Content, Child-Drug Abuse, Selling or Promoting Illegal Materials , Terrorist Extremism ইত্যাদি। এসবকে এক কোথায় বলা হয় YouTube Community Guideline.
৫। এইসব হচ্ছে প্রধান কাজ। তার বাইরেও অনেক কিছু করি, বিশেষ করে বাংলাদেশি YouTuber-দেরকে অনেক ছাড় দেই, তবে সেটা অবশ্যই কোন মেজর নীতি ভঙ্গের বিরুদ্ধে নয়। যদিও সেটা প্রকাশ করি না বা কাউকে বুঝতে দেই না, এতে আমার চাকরি তো যাবে, সাথে জেলও হতে পারে। সম্প্রতি যে ব্যাপারটা লক্ষ্য করলাম সেটা হচ্ছে কিছু বখে যাওয়া, অশিক্ষিত ও অর্ধশিক্ষিত ছেলে সহজ পথে টাকা উপার্জনের নেশায় কিছু চরম সেক্সুয়ালি ভিডিও/ কারো পার্সোনাল ভিডিও সাইতে আপলোড করছে, আর ভিউও হচ্ছে। এদের মধ্যে কিছু ভিডিও YouTube -এর নীতিমালা সরাসরি ভঙ্গ করে না, আর এই সীমাবদ্ধতাকেই ওরা কাজে লাগাচ্ছে। এই সব ভিডিও দেখে আমাদের উঠতি/ তরুণ সমাজ ধ্বংস হচ্ছে, কুপথে পা বাড়াচ্ছে। গত ২/৩ সপ্তাহে নিজের সামান্য ক্ষমতা আর একটু চালাকি করে এমন কিছু Sexually Explicit ভিডিও রিমুভ করলাম, প্রায় ৩০০ এর মত হবে। সেগুলোর মধ্যে ছিলো কারো মোবাইল থেকে চুরি যাওয়া ভিডিও, কারো ফেসবুক এর পার্সোনাল ভিডিও।