হাসপাতাল বা ক্লিনিকের ইমারজেন্সিতে বুকে ব্যথার সমস্যা নিয়ে অনেক রোগী আসেন। তাদের ব্যথা এতই তীব্র হয় যে, তারা যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে চিকিৎসকের কাছে কাকুতি-মিনতি করতে থাকেন। তার বুকে ব্যথা কমিয়ে দিতে যেন এখনই ওষুধ প্রয়োগ করেন। বুকে ব্যথা হলে এসব রোগী বা তার আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে এক ধরনের আশঙ্কা দানা বাঁধে রোগী বুঝি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছেন।
তিনি নিশ্চয়ই ভয়ানক অসুস্থতার শিকার হয়েছেন। প্রাথমিক অবস্থায় ইমারজেন্সি চিকিৎসকও খানিকটা দ্বিধা-দ্বন্দ্বে পড়ে যান। কেননা হৃদরোগীদের ইসিজি, রক্তের এনজাইম পরীক্ষা করে প্রাথমিক স্তরে রোগ ধরা নাও পড়তে পারে। তাই বলে কি চিকিৎসা বন্ধ থাকে? যারা হৃদরোগের বিভিন্ন ঝুঁকি বহন করছেন তাদের চিকিৎসা তৎক্ষণাৎ শুরু হয়ে যায়। কিন্তু বুকে ব্যথা হলেই যে তা হৃদরোগ (এনজিনা) বা অ্যাকিউট করোনারি সিন্ড্রোমের পূর্বাভাস হয়ে দেখা দেবে। এ ধরনের বদ্ধমূল ধারণা থেকে আপনাকে বেরিয়ে আসতে হবে। নানা কারণেই বুকে ব্যথা অনুভূত হতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে হৃদরোগীদের বুকে ব্যথা নাও থাকতে পারে।
নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, শতকরা ৪২ জন নারী এবং ৩০.৭ ভাগ পুরুষ, যারা পরবর্তীতে হৃদরোগ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন, তাদের প্রাথমিক ক্ষেত্রে বুকে ব্যথা ছিল না। আবার ডায়াবেটিস রোগীদের অনেকেরই স্নায়বিক সমস্যা থাকার কারণে বুকে ব্যথা সেভাবে অনুভূত নাও হতে পারে। বুকে ব্যথার নানা কারণ : পাঁজরের হাড়ের সন্ধিস্থলে প্রদাহ বা কোস্টো কন্ড্রাইটিস, পেপটিক আলসার, হার্ট বার্ন বা অ্যাকিউট গ্যাস্ট্রাইটিস, গ্যাস্ট্রোইমোফেজিয়া রিফ্লাক্স ডিজিস, প্যানক্রিয়াটাইটিস, প্লুরোসি, নিউমোনিয়া। মানসিক সমস্যা, আঘাতজনিত কারণ, এ রকম নানা কারণে বুকে ব্যথা দেখা দিতে পারে।
সমীক্ষায় দেখা গেছে, বুকে ব্যথার অন্যতম কারণ হলো মানসিক সমস্যা। শতকরা ৪০ ভাগ ক্ষেত্রে একজন রোগী বুকে ব্যথার সমস্যা নিয়ে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে পারেন। বিশেষ করে শিশু-কিশোরদের শতকরা ৪৫ ভাগ ক্ষেত্রে বুকে ব্যথার অন্যতম কারণে এই মানসিক সমস্যা। সোমাটোফরম ডিজঅর্ডার বা হিস্টিরিয়া নামে সমধিক পরিচিত। এসব মানসিক রোগীর সাধারণ সমস্যাই হলো বুকে ব্যথা। তাদের মানসিক সমস্যা এক সময় শারীরিক সমস্যারূপে আবির্ভূত হওয়ায় সমস্যাটি অনেক ক্ষেত্রে জটিল আকার ধারণ করতে পারে।
হৃদরোগীদের বুকে ব্যথা
এনজিনা, অ্যাকিউট করোনারি সিন্ড্রোম বা মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশনের ব্যথা চিরায়তভাবেই বুকের মাঝখানে হাড়ের পেছনে অনুভূত হয়। হার্ট বুকের বাঁ দিকে থাকলেও বুকের ব্যথা কিন্তু মাঝখানে অনুভূত হয়। এই ব্যথাটি দড়ি বা ব্যান্ডের মতো বুকের চারপাশ ধরে থাকে। রোগী বিশেষ করে যখন সিঁড়ি ভাঙা বা ব্যায়াম বা কষ্টকর কোনো কাজ করেন তখন ব্যথাটি আরও বেশি অনুভূত হয়। রোগী ঘেমে অস্থির হয়ে পড়েন, অনেকের বমি বমি ভাব বা বমি হতে থাকে। এ অবস্থায় রোগীর জরুরি চিকিৎসা যেমন অক্সিজেন, ব্যথার জন্য মরফিন, ইকোস্প্রিন রক্ত জমাটবদ্ধতা প্রতিরোধে এবং প্রয়োজনে স্ট্রেপটোকাইনেজ ইনজেকশন ব্যথা শুরু হওয়ার প্রথম ৮-১০ ঘণ্টার মাঝে প্রয়োজন হতে পারে। তবে বুকে ব্যথা নেই, ইসিজিতে কোনো পরিবর্তন নেই_ এ ধরনের হৃদরোগীরও জরুরি চিকিৎসার প্রয়োজন হতে পারে।
২০০৯ সালে জার্নল ওয়ার ইমারজেন্সি মেডিসিনের প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, ৩৮৭ জন বাছাইকৃত রোগীর ১২৬ জনের প্রথম গ্রুপ যাদের বুকে ব্যথা এবং অপর ২৬১ জনের একটি গ্রুপে যাদের আদৌ কোনো বুকে ব্যথা ছিল না তাদের পরবর্তী সময় এনজিওগ্রাম পরীক্ষা করে শতকরা ৭০ ভাগের ক্ষেত্রে হার্টে ব্লক বা অন্য কোনো ধরনের জটিল হৃদরোগের অস্তিত্ব ধরা পড়েছে। অনেক সময় ভয়াবহ হৃদরোগের শিকার এমন রোগীর ইসিজিতে প্রথম তিন-চার ঘণ্টায় কোনো পরিবর্তন নাও দেখা দিতে পারে। তবে বুকের মাঝখানে ব্যথা, বমি বমি ভাব এসব কিছু নিয়েও অনেক সময় অজীর্ণ, হার্ট বার্ন বা জিইআরডি বা গ্যাস্ট্রোইসোফেজিয়াল রিফ্লাক্স ডিজিসের শিকার হাসপাতালে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে পারেন।
ব্যথা বেশি বা কম হোক বুকে ব্যথা হলে গ্যাস্ট্রিক বা হজমের সমস্যা বলে বাসায় বসে থাকলে হবে না। অনেকে অ্যান্টাসিড ট্যাবলেট, এইচটু ব্লকার বা ওমিপ্রাজল জাতীয় ওষুধ সেবন করে ব্যথা উপশমের চেষ্টা করে থাকেন। এ অবস্থায় সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ হলো চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে মূল রোগের কারণ উদঘাটন করা। অনেক মানসিক বিশেষজ্ঞই এ রোগটির সঠিক সমাধান দিতে পারেন। তবে হৃদরোগ ছাড়াও প্যানক্রিয়াটাইটিস বা অগ্ন্যাশয়ের প্রদাহের কারণেও বুকে তীব্র ব্যথা অনুভূত হতে পারে, যা কি-না মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ স্বাস্থ্য সমস্যা। এক্ষেত্রে জরুরি চিকিৎসার প্রয়োজন।
তারপরও বুকে ব্যথা হলে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। যাদের এনজিনা বা হৃদরোগের ইতিহাস রয়েছে তাদের উচিত জিহ্বার নিচে নাইট্রোগ্গি্নসারিন স্প্রে বা ওষুধ প্রয়োগ করে দ্রুত হাসপাতালে বা কাছের কোনো ক্লিনিকে স্থানাস্তরের প্রস্তুতি নেওয়া। ব্যথা বেশি হলে ওষুধ অনুমাননির্ভর ব্যবহার না করে প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শে হাসপাতালে বা ক্লিনিকে অবস্থান করে ধারাবাহিকভাবে রোগ পরীক্ষা করে দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে।