বিশ্বকাপে খেলে বাংলাদেশেও তবে সেটা বাছাইপর্বে। অতএব বাংলাদেশও আছে বিশ্বকাপে। ফুটবলের সবচেয়ে বড় ও মর্যাদার আসরে তো বাংলাদেশ খেলারই সুযোগ পায় না। সেখানে গৌরব-টৌরভ আসবে কোত্থেকে? অদূরভবিষ্যতে, দূর-ভবিষ্যতে কিংবা কখনো সে সুযোগ আসবে কিনা তা চিন্তারও বাইরে; কিন্তু বিশ্বকাপের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পৃক্ততা তো আছে। তাও তো পার হয়ে গেলো কয়েক যুগ। ৩৩ বছর আগে বাংলাদেশের নাম প্রথম যুক্ত হয়েছিল বিশ্বকাপের সঙ্গে। তারপর থেকে বাংলাদেশ খেলে যাচ্ছে ফুটবলের এ কুলীণ আসরে। কখনো বাছাই পর্ব, কখনো প্রাক-বাছাইয়ে। সিনিয়র ন্যাশনাল পর্যায়ে তিনটি বড় টুর্নামেন্ট আয়োজন করে ফিফা। বিশ্বকাপ, নারী বিশ্বকাপ ও কনফেডারেশন্স কাপ। বিশ্বকাপে ফিফা খেলার সুযোগ দিয়ে থাকে তার প্রতিটি সদস্য দেশকে। এই যোগ্যতায়ই বাংলাদেশ অংশ নিয়ে থাকে বিশ্বকাপের এশিয়া অঞ্চলের বাছাই পর্বে। হোক প্রাক-বাছাই বা বাছাই পর্ব। বিশ্বকাপ বলে কথা। ১৯৭১ সালে পৃথিবীর মানচিত্রে স্বাধীন বাংলাদেশের অন্তর্ভূক্তির পরের বছরই গঠন হয় বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে)। দুই বছরের মধ্যেই বাংলাদেশ পেয়ে যায় ফিফা ও এএফসির সদস্য পদ। যদিও তার আগেই বাংলাদেশের অভিষেক হয় আন্তর্জাতিক ফুটবলে। মালয়েশিয়ার মারদেকা কাপে থাইল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে আন্তর্জাতিক ফুটবলে বাংলাদেশ প্রথম অংশ নেয় ১৯৭৩ সালে। বিশ্বকাপের বাছাই পর্বে খেলতে বাংলাদেশকে অপেক্ষা করতে হয় ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত। ১৯৮৬ সালে মেক্সিকোতে অনুষ্ঠিত ত্রয়োদশ বিশ্বকাপের বাছাই পর্ব দিয়ে ফুটবলের সবচেয়ে বড় এ টুর্নামেন্টে যোগ হয় বাংলাদেশের নাম। তারপর থেকে নিয়মিত অংশগ্রহণ লাল-সবুজ জার্সিধারীদের। বিশ্বকাপের চূড়ান্ত পর্বে আমরা নেই। তারপরও কি বিশ্বকাপ নিয়ে কম মাতামাতি হয় বাংলাদেশে? এক মাস রাত জেগে বিশ্বকাপের খেলা দেখার প্রস্তুতি তো শুরু হয়েছে অনেক আগেই। বাড়ির ছাদে কিংবা গাছের মগডালে পছন্দের দেশগুলোর পতাকা উড়ানো, জার্সি গায়ে জড়িয়ে আর মাফলার গলায় পেঁচিয়ে প্রিয় দলকে সমর্থন দেয়ায় অনেক দেশের চেয়ে এগিয়ে থাকে বাংলাদেশের মানুষ। বিশ্বকাপের বাছাই পর্বে বাংলাদেশ কখন কোন দেশের বিরুদ্ধে খেলেছে, তার ফলাফলই বা কী, তা নিয়ে তেমন আগ্রহ নেই আমাদের দেশের ফুটবলপ্রিয় মানুষের; কিন্তু মূলপর্ব নিয়ে রাজ্যের সব খবর তাদের ঠোঁটের আগায়। তারকাপ্রেমই মূলতঃ ভীনদেশি দল নিয়ে আগ্রহ তৈরির কারণ। এক সময় বাংলাদেশে তারকা ফুটবলার ছিলেন, তখন তাদের পায়ের নখ থেকে মথার চুল পর্যন্ত- সব খবর রাখতেন দর্শকরা। এখন তারকা নেই, দর্শকও নেই। বাংলাদেশের ফুটবল তো এখন অতীতের কঙ্কাল।রাশিয়া বিশ্বকাপের খেলাগুলো বাংলাদেশ শেষ করেছে ২ বছর আগেই। ২০১৬ সালের ২৪ মার্চ অনুষ্ঠিত শেষ ম্যাচটা দুর্বিসহই ছিল লাল-সবুজদের। আম্মানে স্বাগতিক জর্ডানের কাছে ৮-০ গোলে হেরে রাশিয়া বিশ্বকাপের বাছাই পর্বের মিশন শেষ করে বাংলাদেশ। রাশিয়া বিশ্বকাপে বাংলাদেশ গ্রুপে জর্ডান ছাড়াও ছিল অস্ট্রেলিয়া, তাজিকিস্তান ও কিরগিজস্তান। ২০১৫ সালে ৬ নভেম্বর কিরগিজস্তানের বিরুদ্ধে ম্যাচ দিয়ে শুরু হয়েছিল বাংলাদেশের বিশ্বকাপ বাছাই। ঘরের মাঠে ওই ম্যাচ বাংলাদেশ হেরেছিল ১-৩ গোলে। রাশিয়া বিশ্বকাপের বাছাই পর্বে বাংলাদেশ ৮ ম্যাচ খেলে সাফল্য বলতে একটি ড্র। ঢাকায় তাজিকিস্তানের সঙ্গে ১-১ গোলে ড্র করা ছাড়া বাকি ম্যাচগুলোতে হেরেই মাঠ ছাড়তে হয়েছে লাল-সবুজ জার্সিধারীদের। বিশ্বকাপের বাছাই পর্বে বাংলাদেশের প্রথম প্রতিপক্ষ ছিল ইন্দোনেশিয়া। মেক্সিকো বিশ্বকাপের বাছাই পর্বের ওই ম্যাচটি হয়েছিল ১৯৮৫ সালের ১৮ মার্চ জাকার্তায়। প্রথমার্ধ গোলশূণ্য থাকলেও দ্বিতীয়ার্ধে ২ গোল খেয়ে হার দিয়ে বিশ্বকাপ মিশন শুরু করে বাংলাদেশ। ২ এপ্রিল ঢাকায় ইন্দোনেশিয়ার বিপক্ষে ফিরতি ম্যাচের প্রথমার্ধে ১ গোলে পিছিয়ে থেকে দ্বিতীয়ার্ধে ২ গোল দিয়ে বিশ্বকাপের বাছাই পর্বে প্রথম জয়ের মুখ দেখেছিল বাংলাদেশ।পরের ম্যাচেই থাইল্যান্ডকে ১-০ গোলে হারায় স্বাগতিকরা। ওই আসরে বাংলাদেশ গ্রুপে আরো ছিল থাইল্যান্ড ও ভারত। হোম এন্ড অ্যাওয়ে ভিত্তিতে বাংলাদেশ ৬টি ম্যাচ খেলে জয় পেয়েছিল ২টিতে এবং দু’টি ম্যাচই অনুষ্ঠিত হয়েছে ঢাকায়। ইতালী বিশ্বকাপের বাছাই পর্বে বাংলাদেশ গ্রুপে ছিল থাইল্যান্ড, চীন ও ইরান। ফিরতি ম্যাচে থাইল্যান্ডকে ৩-১ গোলে হারিয়ে আসরের একমাত্র জয়টি পায় বাংলাদেশ। বাকি ৫ ম্যাচেই হারতে হয় লাল-সবুজ জার্সিধারীদের। যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বকাপের বাছাই পর্বে বাংলাদেশ অংশ নিয়েছে জাপান, শ্রীলংকা, আরব আমিরাত ও থাইল্যান্ডের সঙ্গে। খেলা অনুষ্ঠিত হয়েছে আরব আমিরাত আর জাপানে। দক্ষিন এশিয়ার দেশ শ্রীলংকাকে দুই পর্বেই হারায় বাংলাদেশ। প্রথম লেগে আরব আমিরাতের কাছে ০-১ গোলে লড়াই করে হারা ছাড়া অন্য কোন ম্যাচে প্রতিরোধ গড়তে পারেনি বাংলাদেশ।ফ্রান্স বিশ্বকাপের বাছাই পর্বে বাংলাদেশ গ্রুপে ছিল মালয়েশিয়া, চাইনিজ তাইপে ও সৌদি আরব। এ আসরে একটি জয় আসে ফিরতি ম্যাচে চাইনিজ তাইপেকে ২-১ গোলে হারিয়ে। জাপান-কোরিয়া বিশ্বকাপের জন্য বাছাই পর্বে বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ ছিল সৌদি আরব, ভিয়েতনাম ও মঙ্গোলিয়া। মঙ্গোলিয়ার বিপক্ষে এক ম্যাচে ৩-০ গোলে জয়, অন্য ম্যাচে ২-২ গোলে ড্র এবং প্রথম ম্যাচে সৌদি আরবের বিপক্ষে ০-৩ গোলের হারই ছিল বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য ফল। জার্মানি বিশ্বকাপের প্রাক-বাছাই পর্বে বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ ছিল তাজিকিস্তান। হোম অ্যান্ড অ্যাওয়ে দুই ম্যাচেই বাংলাদেশ হারে ২-০ গোলের ব্যবধানে। ২০১০ বিশ্বকাপের প্রাক-বাছাই পর্বেও সেই তাজিকিস্তান পড়ে বাংলাদেশের সামনে। ঢাকায় ১-১ গোলে ড্র করলেও অ্যাওয়ে ম্যাচে ৫-০ গোলে হেরে বিদায় নেয় বাংলাদেশ।ব্রাজিল বিশ্বকাপের বাছাই পর্বে বাংলাদেশ প্রথমে দুই ম্যাচ খেলেছে পাকিস্তানের বিপক্ষে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশটিকে ঢাকায় ৩-০ গোলে হারায় বাংলাদেশ। লাহোরে অনুষ্ঠিত ফিরতি ম্যাচ গোলশূণ্য ড্র করে পরের রাউন্ডে খেলে লাল-সবুজ জার্সিধারীরা। প্রতিপক্ষ ছিল মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম শক্তিশালী দল লেবানন। বৈরুতে ০-৪ গোলে হেরে যায় বাংলাদেশ। তবে এমিলি-মিঠুনের গোলে ঢাকায় চমক দেখায় বাংলাদেশ। ২-০ গোলে মধ্যপ্রাচ্যের দেশটিকে হারানোর পর আপসোস বেড়ে যায় বাংলাদেশের। অ্যাওয়ে ম্যাচে বড় হার না হলে প্রথমবারের মতো এশিয়ার শীর্ষ ২০ দলের তালিকায় নাম লেখাতে পারতো লাল-সবুজ জার্সিধারীরা। প্রাক ও বাছাই পর্ব মিলে বাংলাদেশ বিশ্বকাপে এ পর্যন্ত ৪৮ ম্যাচ খেলেছে। এর মধ্যে কখনো কখনো প্রতিপক্ষ ছিল চূড়ান্ত পর্বে খেলার অভিজ্ঞতা সম্পন্ন জাপান, দক্ষিন কোরিয়া, সৌদি আরব, চীন, ইরান, অস্ট্রেলিয়া ও আরব আমিরাত। ৪৮ ম্যাচের মধ্যে ৯ ম্যাচ জিতে, ৫ ম্যাচ ড্র করে ৩৪ টিতেই হেরেছে বাংলাদেশ। নিজেদের বড় জয়টি ৩-০ গোলে ৯৩ সালে শ্রীলংকার বিপক্ষে ও ২০০১ সালে মঙ্গোলিয়ার বিপক্ষে। ৯৩ সালে টোকিওতে জাপানের কাছে ও ২০১৬ সালে দাম্মামে জর্ডানের কাছে ৮-০ গোলে হারা ছিল বিশ্বকাপ বাছাই ফুটবলে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ব্যবধানে হার। হারের এই ভিড়ে বেশ কয়েকটি ম্যাচের ফল আছে, যা এখনো বাংলাদেশের ভাল ম্যাচের উদাহরণ হিসেবে রয়ে গেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ৯৩ সালে জাপানে অনুষ্ঠিত আরব আমিরাতের বিপক্ষে ০-১ গোলে হারের ম্যাচটি। ৮৯ সালে চীন ও ইরানের এবং ২০০১ সালে সৌদি আরবের বিপক্ষে লড়াই করে হারে বাংলাদেশ। জার্মান বিশ্বকাপের প্রাক-বাছাই পর্বে তাজিকিস্তানের বিপক্ষে হোম এন্ড অ্যাওয়ে ভিত্তিতে ২ ম্যাচই হারে ০-২ গোলের ব্যবধানে। ৪৮ ম্যাচে বাংলাদেশ ৩৩টি গোল করেছে। গোল খেয়েছে ১২৩টি।