শহীদ শেখ কামাল ছিলেন বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী
৬৯ বছর আগে ১৯৪৯ সালে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় শেখ কামাল জন্মগ্রহণ করেন। জন্ম তারিখটি হচ্ছে ৫ আগস্ট। তিনি ছিলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জ্যেষ্ঠ পুত্র। ভাইবোনদের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। খুব ছোটবেলা থেকেই শেখ কামাল ডানপিটে ছিলেন। তবে বাবার আদর ¯েœহ থেকে বঞ্চিত ছিলেন। ভিন্ন মাত্রায় যদি বলি তাঁর জন্মের পর থেকে পিতা শেখ মুজিবের সাথে তাঁর ভালমতো দেখাই হতো না। কেননা তাঁর পিতা তখন বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠছেন, বাঙালি জাতির মুক্তিদূত হয়ে উঠছেন। পাকিস্তানি শোষকদের নির্মম শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার কারণে বঙ্গবন্ধুকে (তখনও বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত হন নি) প্রায়ই কারাবরণ করতে হয়।
৫ আগস্ট ২০১৮ বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্ত শহীদ শেখ কামালের ৬৯তম জন্মবার্ষিকী (৭০তম জন্মদিন)। বহুমাত্রিক অনন্য সৃষ্টিশীল ও প্রণোদনা সৃষ্টির অধিকারী তারুণ্যের দীপ্ত প্রতীক শেখ কামাল অনেক নাটকে অভিনয় করেছেন। তার মধ্যে একটি নাটক পশ্চিম বাংলার কলকাতায় মঞ্চস্থ হয়েছে। শেখ কামাল যে সকল নাটকে অভিনয় করেছিলেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য নাটকগুলো হলো ‘অতৃপ্ত কান্না’, ‘থিওরি মৃত্যু ও একটি স্বপ্ন’ এবং ‘ইতিহাসের রায় জনতার জয়’ , ‘এক নদী রক্ত’ ‘পলাতক’, ‘আমি মন্ত্রী হবো’। কলকাতায় যে নাটকটি মঞ্চস্থ হয়েছে তা ছিল বার্নডস এর লেখা ‘কেউ কিছু বলতে পারে না’। এই নাটকটি অনুবাদ করেছিলেন শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনির চৌধুরী। এদিকে নাট্য অভিনয় ছাড়া তিনি ভাল সেতার বাদক ছিলেন। ছায়ানটে সেতার বাদন বিভাগের ছাত্র ছিলেন। সাংস্কৃতিক অঙ্গনে শেখ কামাল একজন বলিষ্ঠ সংগঠক ছিলেন। বন্ধু শিল্পীদের নিয়ে স্পন্দন শিল্পী গোষ্ঠী গড়ে তুলেছিলেন। খুব ছোটবেলা থেকেই ফুটবল, ক্রিকেট, হকি, বাস্কেটবলসহ বিভিন্ন খেলাধুলায় প্রচ- আগ্রহ ছিল শেখ কামালের, ঢাকার শাহীন স্কুলে পড়াশোনার সময় স্কুলের প্রতিটি খেলার তিনি ছিলেন অপরিহার্য অংশ। তবে এর মধ্যে ক্রিকেট তাঁকে টানতো সবচেয়ে বেশি। খেলার জগত থেকে যতদূর জানা যায় যে, তিনি দীর্ঘদেহী ফাস্ট বোলার ছিলেন, নিখুঁত লাইন-লেন্থ আর প্রচ- গতি দিয়ে খুব সহজেই টালমাটাল করে দিতেন প্রতিপক্ষের ব্যাটাসম্যানকে। তিনি উপমহাদেশের অন্যতম সেরা ক্রীড়া সংগঠন আবাহনী ক্রীড়াচক্রের প্রতিষ্ঠাতা । শহীদ শেখ কামাল অক্লান্ত শ্রম দিয়েছিলেন আমাদের দেশের ফুটবল ও ক্রিকেট খেলার মান উন্নয়নের ক্ষেত্রে। ক্রীড়া জগতে অপরিসীম অবদান রেখেছিলেন তিনি। নতুন খেলোয়াড় তৈরি করার জন্য প্রশিক্ষণ শিবির গড়ে তুলতেন এবং তাদের সঙ্গে নিয়মিত অনুশীলন করতেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালযের সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের বাস্কেট বল দলের ক্যাপ্টেন ছিলেন শেখ কামাল। পরবর্তীতে তাঁকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাস্কেট বল টিমের প্রধান করা হয়। ক্রীড়া ক্ষেত্রে গৌরবোজ্জ্বল অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ শহীদ শেখ কামালকে স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার ( মরণোত্তর ) প্রদান করা হয়। পাশাপাশি শিল্প-সাহিত্য ললিতকলার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। তারুণ্যের দীপ্ত প্রতীক শেখ কামাল স্বাধীনতা উত্তর যুদ্ধ-বিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠন ও পুনর্বাসন কর্মসূচীতে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। পাশাপাশি সমাজের পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠির ভাগ্য উন্নয়নে সমাজ চেতনায় উদ্বুদ্ধকরণে মঞ্চ নাটক আন্দোলনের ক্ষেত্রে তিনি একেবারেই প্রথমসারির সংগঠক ও বলিষ্ঠ উদ্যোক্তা ছিলেন। শেখ কামাল ঢাকা থিয়েটারের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। অভিনেতা হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যাঙ্গনে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী তারুণ্যের প্রতীক শহীদ শেখ কামাল ঢাকার শাহীন স্কুল থেকে মাধ্যমিক ও ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগ থেকে বি.এ. অনার্স পাস করেন। ১৯৭৫ সালর ১৫ আগস্টের পূর্বে তিনি সমাজবিজ্ঞান বিভাগের এম এ শেষ পর্বের পরীক্ষা দিয়েছিলেন।
১৯৭৫ সালের ১৪ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ও দেশবরেণ্য অ্যাথলেট সুলতানা খুকুর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। বহুমাত্রিক গুণের অধিকারী শেখ কামাল , তাঁর প্রতিবাদের ভাষা ছিল গান। বিশ^বিদ্যালয় থেকে শুরু করে যখনই সুযোগ পেতেন, তখনই গান গেয়ে অসহিংস প্রতিবাদের অসাধারণ উদাহরণ রাখতেন তিনি। বাংলাদেশ ছাত্রলীগের একজন নিবেদিত, সংগ্রামী, আদর্শবাদী কর্মী ও সংগঠক হিসেবে ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলন, ৬৯-র গণঅভৃত্থান ও ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন শেখ কামাল। নয় মাসের রক্তসাগর পাড়ি দিলেন তিনি। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সন্তান তিনি , নেতৃত্বগুণ আর বাঙালি জাতীয়তাবোধের চেতনা তাঁর ধমনীতে জন্ম থেকেই সংযুক্ত ছিল। মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি কর্নেল এম. এ. জি. ওসমানীর এডিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। যুদ্ধকালীন সময়ে তিনি লেঃ পদে সেনাবাহিনীতে কমিশন লাভ করেন। মুক্তিযুদ্ধের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে পুনরায় শিক্ষা জীবনে ফিরে এসে শেখ কামাল পড়াশুনায় মনোনিবেশ করেন। যতদূর জানা গেছে যে, এ সময় তিনি বাংলাদেশ ছাত্র লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। তবে দেখা গেছে ছাত্র লীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হিসেবে প্রত্যক্ষভাবে ঢাকা মহনগর ছাত্রলীগ দেখাশুনা করতেন তিনি। মাত্র ২৬ বছরের অতি ক্ষুদ্র জীবনকে তিনি অসামান্য সব কর্ম দিয়ে সাজিয়ে ছিলেন আর মতিৃভুমির ইতিহাসের অন্যতম সূর্যসন্তান হিসেবে নিজেকে জানান দিয়ে গেছেন অসম্ভব বিনয়ের সাথে। সেই ২৬ বছর বয়সে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুসহ পরিবারের অন্য সদস্য মা, দুই ভাই ও এক ভাইয়ের স্ত্রী এবং শেখ কামালের সহধর্মিণী দেশবরেণ্য অ্যাথলেট সুলতানা কামাল খুকি একসঙ্গে ঘাতকদের হাতে নির্মমভাবে নিহত হন। ১৫ আগস্টের সেই দুঃসহ স্মৃতি ৪৪ বছর বয়ে বেড়াচ্ছেন তাঁর বড় বোন আওয়ামী লীগের সভানেত্রী বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর ছোট বোন শেখ রেহানা। একজন সুহৃদ ছিল শহীদ শেখ কামাল। সবাইকে দ্রুত আপন করে নিতেন। অত্যন্ত সমাজচেতন ছিলেন তিনি। তাঁর মধ্যে স্বার্থপরতা ছিল না, পাবার চেয়ে দেবার ইচ্ছেটাই ছিল বেশি। কেউ কখনো কিছু চেয়ে খালি হাতে ফিরেছে তাঁর কাছ থেকেÑ এমন কোন দৃষ্টান্ত নেই। সাধারণ্যে মিশতে পেরেছিলেন বলে তারুণ্যের প্রতীক শেখ কামাল সাধারণ থেকে অসাধারণ হয়ে উঠেছিলেন। সার্বিক বিবেচনায় বলতে চাই অসাধারণ গুণের অধিকারী শেখ কামাল আছে, থাকবে উদ্যোগ-উদ্যমের সার্থকতার ইতিহাসে। আমাদের বলিষ্ঠ পদক্ষেপে আগামীতে শহীদ শেখ কামালের ন্যায় কর্মী-সংগঠক-উদ্যোক্তা ফিরে ফিরে আসুক বঙ্গবন্ধুর আদর্শে-সংগ্রামে। তা হলেই বঙ্গবন্ধুর গোল্ডেন বেঙ্গল সোনার বাংলা) এবং দেশরতœ শেখ হাসিনার ডিজিটাল বাংলাাদেশ গড়া সম্ভব হবে।
শেষে শহীদ শেখ কামালের পবিত্র স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি।