শ্রীপুরে বাঁশি তৈরির মহাকারিগর মোজাফ্ফর
শ্রীপুর প্রতিনিধি : এক সময় হাটে হাটে ঝর্ণা কলম মেরামতের নাম ডাক ছিল মোজাফ্ফরের।দওয়াত থেকে কালি সংগ্রহ করে যে কলম তৈরি করা হতো তাই কালি কলম নামে সু পরিচিত ছিল ।গ্রামে যে হাট-বাজারে যেদিন যেখানে হাট বসত সে হাটেই কলম মেরামত করতেন তিনি প্রায় তিনি ৫ বছর ঝর্ণা কলম মেরামতের কাজ করেছেন । সময়ের ব্যবধানে ঝর্ণা কলমের ব্যবহার কমতে কমতে থাকায় কলমের চাহিদাও কমে যায় । যার ফলে একমাত্র উপর্যনের রাস্তা প্রায় বন্ধ হওয়ার পথে । উপার্জন যখন কমতে শুরু করে , বাধ্য হয়ে তিনি বাশি তৈরির কাজ বেছে নেন ।কারণ তখন বাশি বাজানোটা প্রায় সকলের প্রিয় বা শখের মধ্য একটি বস্তু ছিল থখনকার সময়ে । সংসার চালানো বেশ কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে
তাই তিনি বাধ্য হয়ে পেশা পরিবর্তন করেন। মোজাফ্ফর পূর্বে থেকেই শখের বসবর্তী হয়ে বাঁশি বাজাতেন। সে অভিজ্ঞতা আলোকেই বাঁশি তৈরীর কাজ শুরু করেন তিনি। ৪৭ বছর যাবত বাঁশী তৈরী করছেন। দেশে বাঁশী সরবরাহের পাশাপাশি বিশ্বের অন্যান্য দেশেও রপ্তানী করেন। যারা বাঁশি ব্যবহার করেন তাদের কাছেই তিনি অধিক পরিচিত।
বাঁশীর এ কারিগরের নাম মোজাফ্ফর মন্ডল (৬০)। তিনি গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার গাড়ারন গ্রামের মৃত হাজী রেয়াজ উদ্দিন মন্ডলের ছেলে।২০০৮ সালে দিকে তিনি প্রতি বছর প্রায় ২০ হাজার লোকাল বাঁশী বিক্রি করতেন।তখন তিনি প্রতি বছর ২০-২৫ হাজার বাঁশি বিক্রি করতে পারতেন । এ বাঁশিগুলো বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় কুরিয়ার সার্বিসের মাধ্যমে হারমোনিয়াম বা ম্যাজিক্যাল সেন্টারে এ বাঁশিগুলো সরবরাহ করা হয়ে থাকে । বর্তমানে প্রতি বছর বাঁশীর সেট বিক্রি করেন কমপক্ষে ৪০-৬০ টি বাঁশির সেট যা দেশের খ্যাতনামা শিল্পীদের অর্ডারের মাধ্যমেসরবরাহ করা হয়ে থাকে । সঙ্গীতের ব্যাকরণ অনুযায়ী ২৪টি বিভিন্ন ধরণের বাঁশী দিয়ে একটি সেট তৈরী করা হয়। যে বাঁশিগুলো মার্স্টাস টিওন হিসেবে শিল্পীদের নিকট পরিচিত ।
মোজাফ্ফর মন্ডল বলেন, ১৯৬৯ সালের দিকে তিনি নেশা হিসেবেই বাঁশী বাজাতে শুরূ করেন ।এক পর্যায়ে বন্ধুবান্ধব ও প্রতিবেশীরা তাকে বাঁশী তৈরি করতে অনুরোধ করায় তিনি এই কাজে মনোনিবেশ করেণ । গ্রামের মলি বাঁশ দিয়ে কোনরকম বিনিময় ছাড়াই প্রথমে বাঁশী তৈরী করে দিতেন।অল্প সময়ের মধ্যে তার তৈরী বাঁশী এলাকার বাঁশী শিল্পীদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠে। দিনে দিনে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে পারিশ্রমিকের বিনিময়ে বাঁশী তৈরীর অনুরোধ আসে। প্রথম দিকে প্রতিটি বাঁশি ২০- ৫০ টাকায় একটি বাঁশি তৈরী করে দিতেন। এরপর ১৯৭১ সালের দিকে তিনি ব্যবসায়িক লক্ষ্যে বাঁশি তৈরী ও বাজারজাতকরণ শুরু করেন।
বাঁশি তৈরীর জন্য মলি বাঁশ প্রধান উপকরণ। প্রথম দিকে এলাকা থেকে বাঁশ সংগ্রহ করে বাঁশি তৈরী শুরু করেন। কিন্তু এলাকায় মলি বাঁশের উৎপাদন কম হওয়ায় সঙ্কটে পড়েন। ২০০০ সনের পর তার গ্রাহকদের কাছ থেকে মলি বাঁশের পর্যাপ্ত সরবরাহের খবর পান। তাদের দেওয়া তথ্যমতে, চট্টগ্রামের পাহাড়ী এলাকা থেকে মলি বাঁশ সংগ্রহ করেন।
বছরে সেপ্টেম্বর ও মার্চে চট্টগ্রামের পাহাড়ী এলাকা থেকে মলি বাঁশ সংগ্রহ করেন। দু’বারে ৬ হাজার বাঁশ সংগ্রহ করতে হয়। চিকন বাঁশ ৫৫ ও মোটা বাঁশ ৮০ টাকায় ক্রয় করেন। একটি বাঁশে সর্বোচ্চ চারটি বাঁশী হয়। ফাটা, আঁকা বাঁকা ও পোকা খাওয়া বাঁশ বাছাইয়ে বাদ পড়ে। এতে আর্থিকভাবে কিছুটা ক্ষতির সম্মুখিন হলেও তিনি কিন্তু বাঁশি তৈরি করতে থেমে থাকেন না ।
সংগৃহীত বাঁশ প্রথমে রোদে ও পরে ছায়ায় শুকিয়ে নেন। বাঁশ শুকাতে সময় লাগে কমপক্ষে দুই মাস। শুকনো বাঁশ কেটে ভিন্ন ভিন্ন ২৬ প্রকারের সাইজ করতে হয়। প্রতি সেটে ২৬টি বাঁশী থাকে।
একটি বাঁশে সুরের স্কেলে তার ধারণ ক্ষমতা কত একজন কারিগরকে তা বুঝতে হবে। বাঁশের কাটা পাইপগুলো কোনটি কত স্কেলের তা বুঝে একটি সেট করতে হবে। তারপর হাওয়াই চুলোতে লোহার রড গরম করে ছিদ্র করতে হবে। একটি বাঁশীতে ৭টি ছিদ্র করা হয়। যেখান দিয়ে ফুঁ দেওয়া হয় সে ছিদ্রটিকে তিনি ব্যালেন্সিং ছিদ্র বলেন। বাকী ছিদ্রগুলো সুরের স্কেলের স্বরবর্ণ।
ছিদ্র তৈরীর পর একেকটি পাইপ বার্ণিশ করা হয়। এরপর হারমোনিয়াম ও মেশিনের সাহায্যে টিউনিং করে বাঁশী বাজানোর উপযোগী করা হয়। সবশেষে বাঁশী প্যাকেটজাত করা হয়।
এক সেট বাঁশী মানভেদে ৫ থেকে ৭ হাজার টাকায় বিক্রি করেন। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে শিল্পীরা তার বাড়িতে এসে বাঁশী ক্রয় করেন। শিল্পীরাই তার বাঁশীর মূল ক্রেতা। তাদের কাছেই খুচরা এবং পাইকারী দরে বাঁশী বিক্রি করেন।
বগুড়া জেলার মধ্য চেলোপাড়া এলাকার সুর তরঙ্গ স্টোরের রমেশ দাস বলেন, বছরে কমপক্ষে পাঁচ সেট বাঁশী অর্ডার দেন। কারিগর মোজাফ্ফরের কাছ থেকে ১০ বছর যাবত বাঁশী সংগ্রহ করছেন।
কুড়িগ্রাম জেলার ঘোষপাড়া রোড এলাকার সুমন মিউজিক্যাল হাউসের জহুরুল হক বলেন, বছরে দেড় থেকে দুই’শ বাঁশী সংগ্রহ করেন। গত তিন বছর যাবত মোজাফ্ফর তাকে বাঁশী সরবরাহ করছে।
রংপুর জেলার নিউক্রস রোডের সপ্তসুর স্টোরের মালিক জয়ন্ত সরকার বলেন, এক বছর যাবত মোজাফ্ফরের সাথে তার পরিচয় হয়েছে। এসময়ে তিনি দুই’শ বাঁশী সংগ্রহ করেছেন। তার এলাকায় মোজাফ্ফরের তৈরী বাঁশীর চাহিদা রয়েছে।
২০১৩ সনের মার্চে তিউনিশিয়ায় ১ লাখ ৯০ হাজার বাঁশী রপ্তানী করেন। এছাড়া চাহিদা অনুযায়ী সিঙ্গাপুর, ফ্রান্স, ভারত, পাকিস্তান ও অস্ট্রেলিয়ায় বাঁশী রপ্তানী করেছেন। সিঙ্গাপুর, ফ্রান্স, ভারত, পাকিস্তান ও অস্ট্রেলিয়ায় বাঁশি রপ্তানী করেছেন মোজাফ্ফর। বাঁশি তৈরী করে তিনি বর্হিবিশ্বে বাংলাদেশকে ভিন্নমাত্রায় পরিচিতি দিয়েছেন। রপ্তানী প্রক্রিয়ার কাগজপত্রও সংরক্ষণ করেছেন। এখনও বাঁশি তৈরীর পেশায় নিয়োজিত রয়েছেন। প্রায় ৪৭ বছর ধরে মোজাফ্ফর বাঁশি তৈরি করে আসছেন । বাঁশি তৈরী তার জীবিকা নির্বাহের একমাত্র উপায়।
মোজাফ্ফর বলেন, তার প্রধান সহযোগী স্ত্রী সলিমন নেছা। বাঁশী তৈরীর সকল কৌশল তার জানা রয়েছে। সলিমন নেছা বলেন, বিয়ের পর থেকেই স্বামীকে সহযোগিতা করতে গিয়ে বাঁশী তৈরীর শিক্ষা নিয়েছেন। তিনি বলেন, বাড়ির কাছে মসজিদ। মসজিদে মুসল্লীদের যাতায়াত, বাঁশীর সুর শোনা, বাঁশী তৈরীতে নানা উপকরণ ব্যবহারে মুসল্লীদের অসুবিধা হওয়ার কারণে বাঁশী তৈরীর স্থান পরিবর্তন করে বাড়ি থেকে সামান্য দূরে সরিয়ে নিয়েছে। আমি চাই না আমার কোনো কাজ কারও বিরক্তির সৃষ্টি হোক।
বাঁশীর আরও চার কারিগর শাহাজাহান শেখ, রায়হান বেপারী, শান্ত বেপারী ও রুহুল বেপারী। তারা বলেন, গত আট বছর যাবত বাঁশী তৈরীতে সহযোগীতা করছেন।
গাজীপুরের ভাওয়াল বদরে আলম সরকারী কলেজের ¯œাতকোত্তর শিক্ষার্থী আবু হানিফ বলেন, বাঁশী ক্রয়ের জন্য দেশ বিদেশ থেকে শিল্পীরাও তার কাছ থেকে বাঁশী ক্রয় করতে আসে এটা এলাকার সকলের জানা ।
তিনি বলেন,প্রায় ১৭ বছর বয়সে দাম্পত্য জীবণ শুরূ করেন । দাম্পত্য জীবনে তাদের দুই ছেলে ও দুই কন্যা সন্তান রয়েছে। বাঁশী তৈরী করেই তিনি জীবিকা নির্বাহ করেন তিনি। সন্তানদের বিয়ে দিয়েছেন।বাঁশি তৈরি করে উপার্যিত টাকা দিয়ে বাড়ি করেছেন। বর্তমানে তার সাথে চার জন অতিরিক্ত শ্রমিক বাঁশি তৈরির কাজে নিয়োজিত। কথা বলে জানাযায় তিনি নাতী,নাতনী নিয়ে বেশ সুখেই আছেন। তিনি আরো বলেন বাঁশি প্রেমিদের চাহিদা মেঠাতেই আমি দিনরাত পরিশ্রম করে যাচ্ছি। দেশকে ভালবেশে সারাটি জীবণ দেশের কল্যাণে কাজ করে যেতে সকলের সার্বিক সহযোগীতা কাম্য।