সূর্যোদয়ের দেশ জাপানে পাড়ি জমাই এবছর জানুয়ারির ২০ তারিখে। সার্কভুক্ত দেশগুলির প্রতিটি দেশ থেকে জেনেসিস প্রোগ্রামে যোগ দিতে এসেছিল ৯৬ জন তরুণ-তরুণী। জাপান সরকারের অর্থায়নে ও জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো অপারেশন সেন্টার (JICE) এর সরাসরি তত্ত্বাবধানে এশিয়ার সার্কভুক্ত দেশগুলোর সাথে জাপানের এক চমৎকার সেতুবন্ধন হল জেনেসিস প্রোগ্রাম।
জেনেসিসের কথা প্রথম জানতে পারি আমার মেডিকেলের নোটিশ বোর্ড থেকে। এম্বাসি অফ জাপান, বাংলাদেশের পাঠানো একটি নোটিশের মাধ্যমে। জানলাম, এটা একটা ‘ইয়ুথ এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রাম’ । জাপান বরাবরই আমার আগ্রহের জায়গা। তো নিয়ম মতো এপ্লাই করে ফেললাম এবং কী আশ্চর্য ! এম্বাসিতে ভাইভার জন্য ডাকও পেলাম। যখন চুড়ান্ত সিলেকশন এর পর গুলশানের এম্বাসি তে ওরিয়েন্টেশন প্রোগ্রামে আমাদের ডাকা হল, তখনও বিশ্বাস হচ্ছিল না, সত্যি সত্যি জাপান যাচ্ছি!
জানুয়ারির ২০ তারিখ জেনেসিস ২য় ব্যাচ (হেলথ) এর আমরা ১৪ জন রওনা হয়ে গেলাম জাপানের উদ্দেশ্যে।
নারিতা এয়ারপোর্টে নামতেই উষ্ণ অভ্যর্থনা জানালেন আমাদের কো-অর্ডিনেটর। এয়ারপোর্টের বাইরে বেরিয়ে প্রচন্ড ঠাণ্ডার প্রথম ধাক্কাটা কাটিয়ে উঠতেই চোখ জুড়িয়ে গেল। প্রকৃতি আর প্রযুক্তির সুসংহত মেলবন্ধনে গড়ে ওঠা চিবা প্রিফেকচার হয়ে টোকিও পৌঁছাতে লেগে গেল এক ঘন্টা।
প্রথমেই দেখলাম মহামান্য জাপানিজ সম্রাটের বাসস্থান ‘এডো-ক্যাসল’। শতাব্দি প্রাচীন এ স্থাপনার সৌন্দর্য ও বিশালত্ব যে কাউকে হতবিহ্বল করতে বাধ্য। শিনজুকু ওয়াশিংটন হোটেলে যখন পৌছালাম তখনও বুঝিনি কী বিস্ময় আমাদের জন্য পরবর্তী নয় দিনে অপেক্ষা করছে।
এই নয়দিনে আমরা টোকিও ও চিবা প্রিফেকচার এর অসংখ্য দর্শনীয় স্থান ঘুরে বেড়িয়েছি।সকাল ৭ টা থেকে শুরু হতো আমাদের যাত্রা,চলতো রাত পর্যন্ত।
জাপানের দিনগুলিতে আমরা তাদের অকল্পনীয় বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির চমকপ্রদ সব নিদর্শন দেখেছি।প্যানাসনিক সেন্টার, রুসোপিয়া, ট্রান্স টোকিও বে একুয়া লাইন,কামেদা মেডিকেল সেন্টার , এসব ছাড়াও পুরো টোকিও জুড়েই ছিলো প্রযুক্তির ছোয়া।
জাপানিজ রা শুধু বিজ্ঞানেই এগিয়ে যায় নি, নিজস্ব সংস্কৃতির প্রতি তাদের রয়েছে গভীর ভালোবাসা। ইয়োকোহামা ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষক ডঃ কেনজি হাসেগাওয়ার হাত ধরেই প্রথম পরিচয় হলো জাপানিজ সমাজব্যবস্থা আর সংস্কৃতির সাথে।তারপর তো প্রতিটা মুহূর্তেই অনুভব করেছি কেন জাপানিজ রা এতো এগিয়ে।যে জাতি নিজের ঐতিহ্য ধরে রাখতে পারে , তারাই তো উন্নত হবে।
কামোগাওয়া তে যখন গেলাম, সেখান কার শিনসোজি টেম্পল এর প্রধান পুরোহিত আমাদের সম্মানে ট্রেডিশনাল টি সিরিমোনি আয়োজন করেন। আর ইউকাতা কিমোনোর অভিজ্ঞতা তো সুন্দরতম স্মৃতিগুলির একটি। অপরদিকে ,আমরাও লাল সবুজ শাড়ী আর পাঞ্জাবী পরে প্রিয় জন্মভূমিকে নিয়ে গান গাইতে ভুলি নি।
খুব কাছ থেকে দেখেছি বৃদ্ধদের প্রতি তাদের মমতা ও দায়িত্ববোধ,তাইয়ো রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টার এ।দু’দিনের হোম স্টে তে উপলব্ধি করেছি তাদের পরিমিত জীবনাচরণ আর সত্যিকার জাপানিজ পারিবারিক আবহ।
স্বাস্থ্যের ব্যাপারে জাপানিজদের সচেতনতা চোখে পড়ার মতো।কামেদা মেডিকেল সেন্টার ,ইন্টারন্যাশনাল বুডো ইউনিভার্সিটি জীবনের প্রতি আমার দৃষ্টিভঙ্গি অনেকটাই বদলে দিয়েছে।
ওয়ামা রাইস টেরেসে গিয়ে অনুভব করেছি,যে মানুষ মাটির যত কাছে,সে ততই উদার।
জাপানের প্রকৃতির রূপ নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই।সবাই জানে ,জাপান খুব সুন্দর দেশ। প্রশান্ত মহাসাগরের তীরে ট্রেডিশনাল জাপানিজ রিসোর্ট এ বসে যে সূর্যোদয় দেখেছি,তা সারা জীবনের সঞ্চয়। আর যারা জাপানে যাবেন,তাদের কে বলবো ,একবার হলেও কামোগাওয়া সি ওয়ার্ল্ড ঘুরে আসতে।এদের কিলার হোয়েল শো জগৎবিখ্যাত।
জাপানের একটা ব্যাপার শুধু আমার না,আমাদের টীমের সবার হৃদয় ছুয়েছে। তা হল,এদের ধন্যবাদ বলার ও বলানোর আশ্চর্য ক্ষমতা। ট্যুরের দ্বিতীয় দিনেই আমরা অবাক বিস্ময়ে লক্ষ করলাম,আমরাও জাপানিজদের মতো মাথা নেড়ে নেড়ে কথায় কথায় ‘আরিগাতো’ বলছি! একটু হাসি আর একটা থ্যাঙ্ক ইউ যে মন ভালো করার অব্যর্থ ওষুধ, তা আবিষ্কার করলাম জাপান এসেই।
তবে জাইস আয়োজিত এ প্রোগ্রামে আমাদের সবচেয়ে বড় পাওয়া ছিলো, বন্ধুত্ব। বাংলাদেশ,মালদ্বীপ,আফগানিস্তান,পাকিস্তান,শ্রীলঙ্কা,ভারত,ভুটান,নেপাল আর জাপানের বন্ধু। ‘এক ট্রিপে নয় পাখি’ ! রিপোর্টিং সেশনে খুব কাছের বন্ধুকে ছেড়ে আসার বেদনা অনুভব করেছি।
মাত্র ১০ দিনে জাপান আমাকে ‘আরিগাতো’ (ধন্যবাদ) বলতে শিখিয়েছে।নিজের ভুল স্বীকার করে ‘গোমেননাসাই’ (স্যরি) বলতে শিখিয়েছে। নিজের আগে অন্যের সুবিধা অসুবিধার কথা ভাবতে শিখিয়েছে।নতুন করে ভালোবাসতে শিখিয়েছে।
আরিগাতো জাপান।আরিগাতো জেনেসিস।
ডাঃ ফারহা ইসলাম অরিন,
প্রভাষক, ফরেনসিক মেডিসিন
মেডিকেল কলেজ ফর উইমেন এন্ড হসপিটাল,ঢাকা।