‘জয়িতা অন্বেষণে বাংলাদেশ’ শীর্ষক কর্মসুচীতে গাজীপুরের পাঁচ জয়িতা
সরকারের মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মহিলা অধিদপ্তরের উদ্যোগে “জয়িতা অন্বেষণে বাংলাদেশ শীর্ষক” কর্মসূচীর আওতায় গাজীপুর জেলায় ২০১৮-১৯ সালের জন্য পাঁচটি ক্যাটাগরিতে পাঁচ জন শ্রেষ্ঠ জয়িতা নির্বাচিত হয়েছেন। এ পাঁচ জন জয়িতা জীবন সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়ে প্রচন্ড প্রতিকূলতা ও শত বাধা-বিপত্তি ডিঙ্গিয়ে অদম্য প্রাণশক্তিতে স্ব-স্ব ক্ষেত্রে সাফল্যের অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে অন্যদের অনুসরণীয় হয়ে ওঠেছেন । অতীতে এসব জয়িতারা অনেক দুংখ-কষ্ট, নির্যাতন, অভাব-অনটন সহ্য করেও হতোদ্যম না হয়ে নিজেদের ঐকান্তিক চেষ্টায় সাফল্যের গৌরবগাথায় উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে ওঠেছেন। প্রতিকূল পরিবেশে সংগ্রাম করে তারা স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে অনন্য হয়ে ওঠেছেন।
অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী নারী আসমা খাতুন : গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের ৩০ নং ওয়ার্ডের নীলের পাড়া এলাকার আসমা খাতুন নিম্মবিত্ত পরিবারের সন্তান। তার স্বামীর নাম আনোয়ার হোসেন। পরিবারের দৈন্যদশার কারণে ১০ বছর বয়সে ৫ম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় তার বিয়ে হয়। স্বামী বেকার হবার কারণে তিনি শ^শুর-শাশুড়ী ও ননদের দ্বারা নির্যাতিতা হন। কিন্তু সকল নির্যাতন উপেক্ষা করে লেখা-পড়া চালিয়ে যান এবং কষ্টে এসএসসি পাশ করেন। এরপর এইচএসসিতে ভর্তি হলেও ছেলের অসুস্থতার কারণে পরীক্ষা দিতে পারেননি। এরপর একটি এনজিওতে চাকুরী নিলেও এনজিওটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় প্রবল আর্থিক সমস্যায় পড়েন। এ অবস্থায় তিনি জেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে একটি সমিতির রেজিস্ট্রেশন পেয়ে নারীর ক্ষমতায়নের জন্য তাদের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করেন। সিডিসি গঠন করে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন থেকে একটি প্রকল্পের অনুমেদন পেয়ে নারীর ক্ষমতায়ন ও দক্ষতা বৃদ্ধির প্রশিক্ষণ দেন। তিনি নিজেও গরু মোটাতাজাকরণ, গাভী ও হাঁসমুরগী পালনের উপর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। এরপর একটি গাভী ক্রয় করে শুরু করেন গাভী পালন। বর্তমানে তার ৪টি গাভী, ৩টি ষাড় ও ৩টি বকনা বাছুরসহ ১০টি গরু রয়েছে। সেগুলোর আনুমানিক বাজার মূল্য ১০ লক্ষ টাকা । গাভীগুলো থেকে তিনি প্রতিদিন ৫০ লিটার দুধ পান। প্রতি লিটার ৫০ টাকা ধরে বিক্রি করে মাসে ৭৫ হাজার টাকা আয় করেন। এ ছাড়া হাঁস-মুরগী ও শাকসবজী বিক্রি করে সব মিলিয়ে তিনি মাসে ৮৫ হাজার টাকা আয় করেন। বর্তমানে তার সংসারে স্বচ্ছলতা ফিরে এসেছে। নিজ প্র”েষ্টায় তিনি এখন অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী।
শিক্ষা ও চাকুরী ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনকারী নারী আয়েশা আক্তার : আয়েশা আক্তারের স্বামীর নাম মোঃ ওহেদুজ্জামান, মাতা- সুফিয়া জামান, বাড়ি তেলিহাটী, শ্রীপুর। আয়েশা আক্তারের পিতার আর্থিক অবস্থা মোটামুটি ভালো থাকলেও সামাজিক কুসংস্কারের কারণে তিনি বাল্যবিয়ের শিকার হন। ঘরে সৎ মা থাকার কারণে পিতা তাকে এসএসসি পাশ করার আগেই বিয়ে দেন। লেখা–পড়ার অদম্য ইচ্ছার কারণে শ^শুর বাড়ীর বাধা বিপত্তি সত্তে¡ও বড় ভাইয়ের সহযোগিতায় তিনি জাতীয় বিশ^বিদ্যালয়ের অধীনে ইসলামের ইতিহাস বিষয়ে সম্মান ও মাস্টার্স পাশ করেন। মেয়ে সন্তান হওয়ার কারণে তিনি শ^শুর বাড়ীতে নানান ধরনের মানসিক নির্যাতনের শিকার হন। স্বামী তাকে তালাক দিয়ে আরেকটি বিয়ে করেন। সন্তানের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে বাবার বাড়ীতে ফিরে এসে অনেক কষ্টে জীবন শুরু করেন। টিউশনি করে নিজের ও মেয়ের লেখাপড়ার খরচ চালান। বর্তমানে তিনি শ্রীপুর উপজেলার মাওনা চৌরাস্তা পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজে প্রভাষক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। তার একমাত্র মেয়ে বঙ্গবন্ধু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়ে পদার্থ বিজ্ঞান বিষয়ে ২য় বর্ষে অধ্যয়ন করছে। পাশাপাশি তিনি বাল্য বিবাহ, যৌতুকপ্রথা রোধ ও নারীর ক্ষমতায়ন ইত্যাদি বিষয়ে মেয়েদের সচেতন করার মাধ্যমে তাদের আতœনির্ভরশীল করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছেন।
সফল জননী নারী আছমা আহম্মেদ খান : আছমা আহম্মেদ খানের স্বামী নাজির আহম্মেদ খান, মাতা মৃত আমেনা বেগম। বাড়ি- বেরুয়া, বক্তারপুর, কালীগঞ্জ। দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় বাবা-মা আছমাকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়ে দেন। স্বামীর স্বল্প উপার্জনে কোন রকমে সংসার চলছিল। সংসারে আয় বৃদ্ধির জন্য আছমা আয় বৃদ্ধিমূলক প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করেন। প্রশিক্ষণ গ্রহণের পর হাঁস-মুরগী পালন, গরু মোটা তাজাকরন এবং সবজি চাষ করে নিজের সংসারের আয় বৃদ্ধি করেন। এর মাঝেই তিনি দু’ সন্তানের জননী হন। সংসারের এমন অভাব অনটনের মাঝেও দু’ সন্তানের পড়াশুনা চালিয়ে যান। যার ফলে আছমা আহম্মেদের প্রথম মেয়ে নাজমুন নাহার ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় হতে এম.বি.এ পাস করে। পরে ৩৭তম বিসিএস (পররাষ্ট্র) পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে কৃতকার্য হয়। দ্বিতীয় সন্তান মেহেদী হাসানও ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় থেকে এম.বি.এ পাস করে ৪০তম বিসিএস পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন করেছে। বর্তমানে সে একটি প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে মনোবিদ হিসাবে কর্মরত আছে। জীবনযুদ্ধে জয়ী এ মা’র সফলতা আজ সকলের মুখে মুখে।
নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে নতুন উদ্যমে জীবন শুরু করেছেন যে নারী- মোসাঃ বানু আক্তার : বানু আক্তারের স্বামী খোরশেদ আলম, মাতা- মহিমা বেগম, বাড়ি দেওয়ালিয়া বাড়ি, নীলনগর, গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন। বানু এক হতদরিদ্র পরিবারের সন্তান, শারীরিক প্রতিবন্ধী হয়ে জন্মগ্রহণ করায় মা-বাবা তাকে দেখে ভয় পেয়েছিল। ১০-১২ বছর পর্যন্ত সে হাটতে পারেনি। পরে লাঠি ধরে আস্তে আস্তে হাটতে শেখে। পড়াশুনার প্রতি ছিল বানুর খুবই আগ্রহ। সে স্কুলে যেতে চাইলে তার দুই হাত নেই বলে মা-বাবা তাতে রাজী হয়নি। কিন্তু বানু স্কুলে যাবার জন্য কান্নাকাটি করতো। তার কান্না দেখে গ্রামের ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য তার পড়ার ব্যবস্থা করে দেন। দু’হাত নেই বলে সে পা দিয়ে লেখা শিখে। কিন্তু হঠাৎ করে ইউপি সদস্য মারা গেলে তার লেখাপড়ার খরচ বন্ধ হয়ে যায়। তবু যুদ্ধ করে ৫ম শ্রেণি পাস করেন। ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে তিনি কাপড় কেটে জামা বানানো ও পুথির কাজ শেখেন। দুটি হাত নেই বলে মা-বাবা তাকে এক পাগলের সাথে বিয়ে দিতে চাইলে তিনি রাজী হননি। পরে তিনি একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী ছেলেকে বিয়ে করেন। তার একটি ছেলে সন্তান হলে স্বামী অন্যত্র বিয়ে করে তাকে ফেলে চলে যায়। হাত না থাকায় তিনি পা দিয়ে পুথির ব্যাগ, পুতুল, আপেল, আঙ্গুর ইত্যাদি তৈরী করে সেগুলোর মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করছেন। বর্তমানে তার মাসিক আয় ১০ হাজার টাকা। এভাবে তিনি প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে সামনে এগিয়ে যাবার জন্য জীবন সংগ্রাম করে যাচ্ছেন।
সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদান রেখেছেন যে নারী- আনোয়ারা বেগম : আনোয়ারা বেগমের স্বামীর নাম মোঃ জসিম উদ্দিন। মাতার নাম মোছাঃ শরিফা খাতুন। বাড়ী গাড়ারন, শ্রীপুর, গাজীপুর। আট ভাই-বোনের বড় সংসারে লেখা-পড়ার খরচ যোগানো খুব কষ্টকর বিধায় ৮ম শ্রেণিতে ওঠার পর পিতা-মাতা আনোয়ারাকে বিয়ে দেন। তার স্বামী প্রায় সময়ই অসুস্থ থাকতো। অভাবের সংসারে স্বামীকে সহায়তা করার জন্য আনোয়ারা সেলাই কাজ শিখেন। শ্রীপুরের মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে সেলাই প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে একটি মহিলা সমিতি গঠন করেন। সমিতির কার্যালয়ে দুটি সেলাই মেশিন দিয়ে সেলাই কাজ শুরু করেন। সেলাই প্রশিক্ষক হিসেবে বিভিন্ন জায়গায় সেলাই প্রশিক্ষণ দেন। যেমন হাঙ্গার প্রজেক্ট, ঢাকা আহসানিয়া মিশন, প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ ইত্যাদি। এছাড়াও হস্তশিল্প, বাঁশ- বেতের কাজ, হাঁস-মুরগী পালন, শাক-সবজির চাষ ইত্যাদি বিষয়ে মহিলাদের প্রশিক্ষণ দেয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক সচেতনতামুলক কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকেন। তার অধীনে বর্তমানে ৩০ জন মহিলা বিভিন্ন আয় বর্ধকমূলক কাজ করে যাচ্ছেন। এছাড়া বাল্য বিবাহ, যৌতুক ও নারী নির্যাতন বন্ধসহ বিভিন্ন কাজেও তিনি সম্পৃক্ত রয়েছেন। জীবনযুদ্ধে জয়ী আনোয়ারা বেগম সমাজে নারীর ক্ষমতায়ন বৃদ্ধিতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন।