মুকুল কুমার মল্লিক : ১৯৭১ সালের ১৫ ডিসেম্বর গাজীপুর পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীমুক্ত হয়। এ দিন অর্থাৎ ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত গাজীপুরের (তৎকালীন জয়দেবপুর) ছয়দানা এলাকায় পাকিস্তানী দখলদার বাহিনীর সঙ্গে মুক্তি ও মিত্র বাহিনীর সম্মুখযুদ্ধ চলে। এ যুদ্ধে পাকিস্তানী বাহিনীর একটি কনভয় সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়। ফলে কার্যত: ১৫ ডিসেম্বর গাজীপুর পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীমুক্ত হয়ে পড়ে। সেদিন কিছু মুক্তিযোদ্ধা মুক্ত গাজীপুরে (জয়দেবপুর) প্রবেশ করলেও ১৬ডিসেম্বর সকালে সম্মিলিতভাবে বিজয়ী মুক্তিযোদ্ধারা জয় বাংলা ধ্বনি দিয়ে শত্রুমুক্ত গাজীপুরে প্রবেশ করে।
১৯৭১ সনের মহান মুক্তিযুদ্ধে গাজীপুরবাসীর রয়েছে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা। ১৯৭১ সালের ২৬মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। এর পূর্বে ১৯মার্চ তৎকালীন জয়দেবপুরেই সংগঠিত হয়েছিল পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধ। সেদিন জয়দেবপুর রাজবাড়ী সেনানিবাসে অবস্থিত ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সৈন্যদের নিরস্ত্র করতে আসা পাকিস্তানী বাহিনীর বিরুদ্ধে জয়দেবপুরের বীর জনতা সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল, সেদিনই প্রথম বাঙালিদের পক্ষ থেকে গর্জে উঠেছিল বন্দুক। সেদিন শহীদ হয়েছিলেন হুরমত, নিয়ামত, মনু খলিফা এবং পরে আহত অবস্থায় কানু মিয়া। এ ঘটনায় সে সময় সমগ্র বাংলাদেশে স্লোগান ওঠেছিল ‘জয়দেবপুরের পথ ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’।
১৯৭১ সালের ২৫মার্চ কালরাত্রিতে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালিদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে জঘন্য গণহত্যা শুরু করে। এ অবস্থায় বঙ্গবন্ধু ২৬মার্চ প্রথম প্রহরে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। ২৯মার্চ দুপুরে পাকিস্তানী বাহিনী বিমান হামলা চালিয়ে পরে সড়ক পথে এসে জয়দেবপুর দখল করে নেয়। তখন এলাকার বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের সাথে ছাত্র-শিক্ষক-কৃষক-শ্রমিক-জনতা মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে ভারতে চলে যান। পরে ভারতের বিভিন্ন ট্রেনিং ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে জয়দেবপুরের আশেপাশে চলে আসেন। তারা বিভিন্ন ক্যাম্পে ও স্থানে আশ্রয় নিয়ে পাকিস্তানী সামরিক ক্যাম্প, স্থাপনা, টহলরত সৈন্যদের উপর এবং ব্রীজ, কালভার্ট ও বৈদ্যুতিক খুঁটিতে হামলা চালাতে থাকেন। এসব আক্রমণ ক্রমশ: জোরদার হতে থাকে এবং নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে মুক্তিযোদ্ধারা সম্মিলিত আক্রমন শুরু করেন। ৩ডিসেম্বর থেকে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হলে মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ আরো জোরালো হয়ে ওঠে। ১২ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা জয়দেবপুরে সম্মিলিত আক্রমণ চলাকালে পাকিস্তানী সৈন্যরা ভীত ও কোনঠাসা হয়ে পড়ে। ১৩ ডিসেম্বর পূবাইলে মুক্তিযোদ্ধারা জোরালো আক্রমণ চালায় এবং মাইন দিয়ে পাকিস্তানী সৈন্যবোঝাই ট্রেনের কয়েকটি বগি ফেলে দিলে বেশ কিছু সৈন্য নিহত ও আহত হয়। এদিকে মুক্তি বাহিনীর জোরালো আক্রমণে ভীত হয়ে রাজবাড়ী সেনানিবাস, অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরী, মেশিন টুলস ফ্যাক্টরী ও রাজেন্দ্রপুর অর্ডন্যান্স ডিপোতে অবস্থানরত পাকিস্তানী সৈন্যরা ঢাকায় পালিয়ে যেতে মনস্থ করে খন্ড খন্ড ভাবে চান্দনা-চৌরাস্তায় জড়ো হতে থাকে। উত্তর রণাঙ্গন অর্থাৎ ময়মনসিংহ, জামালপুর, শেরপুর ও টাঙ্গাইল থেকেও পাকিস্তানী সৈন্যরা মুক্তি ও মিত্র বাহিনী এবং কাদেরিয়া বাহিনীর প্রবল আক্রমণে টিকতে না পেরে সড়ক পথে ঢাকা পালিয়ে আসতে শুরু করে। তারাও পথিমধ্যে কড্ডা ব্রীজ উড়িয়ে দিয়ে চান্দনা-চৌরাস্তায় জড়ো হতে থাকে। এভাবে চান্দনা-চৌরাস্তা থেকে পাকিস্তানী বাহিনীর বিরাট একটি বড় কনভয় ১৪/১৫ডিসেম্বর ঢাকার পথে রওনা হয়। এদিকে টাঙ্গাইল থেকে পিছু ধাওয়াকারী মিত্র ও মুক্তি বাহিনী কড্ডা ব্রীজ পার হতে না পেরে কাশিমপুর জড়ো হয়। পাকিস্তানী বাহিনী ঢাকার পথে ছয়দানা নামক স্থানে পৌঁছলে কাশিমপুর থেকে সম্মিলিত বাহিনী মর্টার-কামানের সেল নিক্ষেপ এবং প্রচন্ড গুলিবর্ষণ করতে থাকে। এছাড়া রাস্তার পাশের্^ বিভিন্ন ট্রেঞ্চ থেকে বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত মুক্তিবাহিনীও ব্যাপক গুলিবর্ষণ করতে থাকে। এমন সম্মিলিত আক্রমণে বিপর্যস্থ পাকিস্তানী বাহিনীর বিরাট কনভয়টি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়। এখানে নিহত হয় ৪/৫ শত পাকিস্তানী অফিসার-সৈনিক এবং ধ্বংস হয় ট্যাংক-কামান-মর্টারসহ প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ ও যানবাহন। মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে বিজয় লাভের পূর্বে ঢাকার কাছে এটাই ছিল বড় ধরনের একটি সম্মুখযুদ্ধ। সম্মিলিত বাহিনীর আক্রমণ ১৫ডিসেম্বর সন্ধ্যা পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। ছয়দানা নামক স্থানে পাকিস্তানী বাহিনীর পরাজয়ের ফলে ১৫ডিসেম্বর কার্যত জয়দেবপুর (গাজীপুর) পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী মুক্ত হয়ে যায়। এ দিন কিছু মুক্তিযোদ্ধা বিজয়ী বেশে মুক্ত জয়দেবপুরে প্রবেশ করলেও ১৬ডিসেম্বর সকালে সম্মিলিতভাবে বিজয়ী বীর মুক্তিযোদ্ধারা জয় বাংলা ধ্বনিতে চারদিক মুখরিত করে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী মুক্ত গাজীপুরে প্রবেশ করেন।