ঠোঁটের জন্য শীতকাল বছরের সবচেয়ে কঠিন সময়। ঠা-া থেকে বাঁচতে আমরা সারা শরীর ঢেকে রাখি, কিন্তু ঠোঁট কখনোই ঢাকা হয় না। অথচ হাত বা মুখের ত্বকের চেয়ে ঠোঁটের ত্বক ১০ গুণ বেশি তাড়াতাড়ি আর্দ্রতা হারিয়ে ফেলে। ঠোঁটে খুব কম তৈলগ্রন্থি থাকে, তা ছাড়া ঠোঁটের ত্বকে সূর্যরশ্মিকে ফিল্টার করে মেলানিন তৈরি করে ত্বককে রক্ষা করার ক্ষমতাও নেই। ঠোঁট ফেটে যাওয়া ও ঠোঁটের চামড়া ওঠা খুবই যন্ত্রণাদায়ক দু’টি সমস্যা। এই সমস্যাগুলোর সেরা সমাধান হলো ঠোঁটের ত্বকের পুষ্টি ও ময়েশ্চার নিশ্চিত করা। ঠোঁট একবার ফেটে গেলে তা রাতারাতি ঠিক করা খুবই কঠিন। কিন্তু একটু যতœবান হলে কয়েকদিনের মাঝেই ঠোঁটের হারানো সৌন্দর্য ও স্বাস্থ্য ফিরে পাওয়া সম্ভব।
প্রথমেই জেনে নেয়া যাক ঠোঁট ফেটে যাওয়া ও ঠোঁটের চামড়া ওঠার কিছু কারণ। আবহাওয়া একটি বড় কারণ ঠোঁট ফেটে যাওয়া ও ঠোঁটের চামড়া ওঠার। শুষ্ক ও ঠা-া আবহাওয়া, সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি, প্রবল বাতাস ইত্যাদির সংস্পর্শে এলে ঠোঁট ফেটে যেতে পারে এবং ঠোঁট রুক্ষ্ম হয়ে যেতে পারে। এ ছাড়া ব্যক্তিগত কিছু অভ্যাসও এই সমস্যার জন্য দায়ী। যেমনÑ বারবার জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভেজানো, ধূমপান ও মদ্যপান ইত্যাদি। এ ছাড়াও ওষুধের প্রতিক্রিয়া ও টুথপেস্টে থাকা কিছু উপাদান এই সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। পর্যাপ্ত পানি পান না করাও এই সমস্যার জন্য দায়ী।
কী করলে শীতেও সুন্দর থাকবে ঠোঁট?
প্রথমত, ভুল করেও জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভেজানোর মতো ভুল করবেন না। ঠোঁট শুকনো মনে হলে জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভেজালে হয়তো কয়েক মিনিটের জন্য আরাম পাওয়া যায়, কিন্তু আসলে এটা করলে ঠোঁট আরো বেশি রুক্ষ্ম হয়ে যায়। থুথুতে থাকা এনজাইম, যা খাবার হজমে সাহায্য করে, ঠোঁটের জন্য ক্ষতিকরও বটে।
এমন একটি লিপবাম ব্যবহার করুন যা অয়েন্টমেন্ট বেসড। এটা ঠোঁটের আর্দ্রতা লক করে ফেলে, ফলে ঠোঁট ভালো থাকে। এমন একটি অয়েন্টমেন্ট বেছে নিন, যাতে বিসওয়াক্স, পেট্রোলিয়াম জেলি, অ্যাসেনশিয়াল অয়েল, গ্লিসারিন, সানস্ক্রিন ইত্যাদি আছে।
যেসব লিপবামে ক্যাম্ফোর, মেন্থল ও ইউক্যালিপ্টাস আছে, সেগুলো আসলে ঠোঁট রুক্ষ্ম করে ফেলে। তাই এসব উপকরণ আছে যে লিপবামে, তা এড়িয়ে চলুন।
ঠোঁটের চামড়া উঠতে শুরু করলে কখনোই সেই চামড়া ধরে টানাটানি করবেন না। এতে ঠোঁট ফেটে রক্ত বের হতে পারে, ঠোঁট ফুলে যেতে পারে। এরকম পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে চামড়া তোলার জন্য অস্থির না হয়ে ভারী কোনো লিপবাম লাগান যাতে মরা চামড়া নরম হয়ে নিজে থেকেই উঠে যায়।
ঠোঁট যদি ফেটে যায়, সাথে সাথে তার প্রতিকার শুরু করুন। যত দেরি করবেন, সমস্যা তত বাড়বে।
শীতকালে আবহাওয়ার প্রকোপ থেকে ঠোঁট বাঁচাতে বাইরে বের হওয়ার সময় স্কার্ফ বা ডিসপোজেবল মাস্ক পরতে পারেন। আর অবশ্যই সানস্ক্রিন আছে এমন লিপবাম লাগাবেন কারণ সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি ঠোঁটকে রুক্ষ্ম করে ফেলে এবং এ থেকে ঠোঁটের চামড়া ওঠার সমস্যা শুরু হয়। হাত দিয়ে বারবার ঠোঁট স্পর্শ করা যাবে না। এতে ঠোঁটে জীবাণু সংক্রমণ হতে পারে।
ঠোঁট সুন্দর রাখতে ধূমপান ও মদ্যপানের অভ্যাস ত্যাগ করতে হবে। ধূমপান ঠোঁটকে শুধু রুক্ষ্মই করে না, বরং কালোও করে ফেলে।
একটি স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস শুধু শরীরের জন্য বা ত্বকের জন্য নয়, ঠোঁটের জন্যও জরুরি। ভিটামিন ও অন্যান্য জরুরি নিউট্রিএন্ট ঠোঁটের স্বাস্থ্যরক্ষায় সরাসরি ভূমিকা রাখে। তাই প্রতিদিনের খাবারের তালিকায় রাখুন ফল, শাক-সবজি, মাছ বা মুরগি।
প্রতিদিন নানা ধরনের লিপস্টিক লাগানো হয় ঠোঁটে। এই নানা লিপ্সটিকের ভিড়ে ঠোঁট যেন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে নিঃশ্বাস নেয়ার সুযোগ পায়, এটা নিশ্চিত করুন। ঘুমানোর আগে অবশ্যই ঠোঁট থেকে মেকআপের শেষ ছিটেফোটা পর্যন্ত তুলে ফেলতে হবে। একটি তুলার প্যাড বা বলে মেকআপ রিমুভার বা তেল নিয়ে হালকা করে ঘষে ঠোঁটের মেকআপ তুলে নিন।
শীতকালে ঠোঁটের যতেœর প্রতিদিন করণীয়
প্রতিদিন ঠোঁট এক্সফলিয়েট করা খুবই জরুরি। এতে করে ঠোঁটে মরা চামড়া জমতে পারে না, ফলে ঠোঁট থাকে স্বাস্থ্যবান। বাজারে অনেক ধরনের লিপস্ক্র্যাব পাওয়া যায়। প্রতিদিন রাতে আলতো হাতে ঠোঁট এক্সফলিয়েট করে নিন। যদি হাতে সময় থাকে, বাজারের লিপস্ক্র্যাব ব্যবহার না করে ঘরেই তৈরি করে নিতে পারেন লিপস্ক্র্যাব।
ঠোঁটের রুক্ষ্মতা এড়াতে ঘুমানোর আগে অবশ্যই ঠোঁটে লিপবাম বা পেট্রোলিয়াম জেলি লাগাতে হবে। ঘুমালে ঠোঁট খুব তাড়াতাড়ি আর্দ্রতা হারায়। এই ঋতুতে অনেকেই নিজের অজান্তে রাতের বেলা হা করে ঘুমায়, ফলে ঠোঁট আরো বেশি আর্দ্রতা হারায়। তাই পেট্রোলিয়াম জেলি বা লিপবামকে ঠোঁটের নাইট মাস্ক হিসেবে ভেছে নিন যা সারারাত আপনার ঠোঁটকে রুক্ষ্মতা থেকে রক্ষা করবে।
সবসময় হাতের কাছে একটি লিপবাম রাখুন। বাসায় একটি, ব্যাগে একটি, গাড়িতে একটি, আর অফিসেও একটি। এতে করে যখনই ঠোঁট শুকনো মনে হবে, সাথে সাথে হাতের কাছে থাকা লিপবামটি ঠোঁটে লাগিয়ে নিতে পারবেন।
প্রতিদিন অন্তত ৫ মিনিট ঠোঁট মাসাজ করুন। এতে ঠোঁটে রক্তসঞ্চালন বৃদ্ধি পাবে এবং প্রয়োজনীয় পুষ্টির সরবরাহ নিশ্চিত হবে।
মেয়েরা বাইরে বের হওয়ার সময় ভারী ধরনের লিপস্টিক ব্যবহার করুন। এতে করে ঠোঁটের ওপর একটি প্রলেপ থাকবে যা বাইরের আবহাওয়া ও ধুলাবালির হাত থেকে ঠোঁটকে কিছুটা হলেও রক্ষা করবে।
শীতকাল হোক বা গ্রীষ্মকাল, ঠোঁটের আর্দ্রতা ধরে রাখতে পর্যাপ্ত পানি পানের বিকল্প নেই। পানি কম খেলে যত লিপবাম লাগান, আর যতই যতœ করেন না কেন, ঠোঁটের রুক্ষ্মতা বারবার ফিরে আসবে। যেখানেই যান, সাথে একটি পানির বোতল রাখুন।
ঘরেই করুন রুক্ষ্ম ও ফাটা ঠোঁটের যতœ
ক্স রুক্ষ্ম ঠোঁটে লাবণ্য ফিরিয়ে আনার জন্য তেল খুব ভালো একটি উপাদান। নারকেল তেল, অলিভ অয়েল বা ক্যাস্টর অয়েলে আছে ফ্যাটি এসিড যা ঠোঁট সুন্দর ও লাবণ্যময় করে তোলে। ১ টেবিল চামচ নারকেল তেল, অলিভ অয়েল বা ক্যাস্টর অয়েলের সাথে ২-৩ ফোঁটা টি ট্রি অয়েল বা নিম অয়েল মিশিয়ে নিন। ঠোঁটে লাগিয়ে রাখুন সারারাত। দিনে ২-৩ বার লাগাতে হবে।
ক্স মধু ও ভেসলিন দিয়েও করা যায় শুষ্ক ও ফাটা ঠোঁটের চিকিৎসা। প্রথমে ঠোঁটে মধু লাগান। তারপর মধুর ওপরে ভেসলিন লাগান। ১৫ মিনিট রাখুন। এরপর ভেজা টিস্যু বা কাপড় দিয়ে মুছে ফেলুন। ভালো ফল পাওয়ার জন্য এটা প্রতিদিন একবার করে একটানা সাত দিন করতে হবে।
ক্স শুষ্ক ঠোঁটের যতেœ গ্রিন টি ব্যাগ খুব উপকারী। ১ কাপ গরম পানিতে একটি গ্রিন টি ব্যাগ ১০ মিনিট ভিজিয়ে রাখুন। তারপর এই ব্যাগটি তুলে নিয়ে ঠোঁটে চেপে রাখুন। ১০ মিনিতে পর সরিয়ে নিন। এতে করে ফাটা ঠোঁটের যন্ত্রণা কমবে।
ক্স ঠোঁটের মরা চামড়া দূর করতে এই পদ্ধতিটি অবলম্বন করুন। ১ চা চামচ চিনি, কয়েক ফোঁটা অলিভ অয়েল, আধা চা চামচ চিনি একসাথে মিশিয়ে নিন। এবার এটি ঠোঁটে লাগিয়ে আলতো করে ঘষুন। ৫ মিনিট পর কুসুম গরম পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। প্রথম দুই সপ্তাহ ১ দিন পরপর করুন এই প্রক্রিয়াটি। তার পর থেকে সপ্তাহে ২ দিন করে করলেই চলবে। এই পদ্ধতিটি অবলম্বন করলে ঠোঁট নরম, কোমল ও তরতাজা হবে।
ক্স ১ ফোঁটা ঘি ফাটা ঠোঁটে জাদুকরি প্রভাব ফেলতে পারে। ঘি প্রাকৃতিক ময়েশ্চারাইজার হিসেবে কাজ করে। ১ ফোঁটা ঘি সারারাত ঠোঁটে লাগিয়ে রাখুন। পরপর কয়েকদিন করলে ফাটা ঠোঁট একদম ভালো হয়ে যাবে।
ক্স মধু ও গ্লিসারিন সমপরিমাণে নিয়ে একসাথে মিশিয়ে একটি কৌটায় রাখুন। ফাটা, রুক্ষ্ম বা চামড়া ওঠা ঠোঁটে প্রতিদিন রাতে ঘুমানোর সময় লাগিয়ে সারারাত রাখতে হবে। ২-৩ দিনের মাঝেই ঠোঁটের সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে।