শাহান সাহাবুদ্দিন:
হোম কোয়ারেন্টাইন এ আছি নিজের সচেতনতার অংশ হিসেবে এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের নির্দেশে, এটি একটি দিক। অন্যদিক বন্যার জলের মতো গাজীপুরে ঢুকছে শ্রমজীবী মানুষ। তাও রাষ্ট্রযন্ত্রের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সিগন্যাল নিয়েই। এটি আরেকটি দিক। শ্রমজীবী মানুষকে মহাজীবনের দায় মেটাতে হয়। মেটাতে তারা বাধ্য। কারখানার বাঁশি বেজে ওঠলে তাদেরকে কারখানায় ফিরতেই হবে। এছাড়া উপায় নেই। না ফিরলে চাকুরী থাকবে না। চাকুরী না থাকলে না খেয়ে মরতে হবে। শুধু কি চাকুরি করা লোকটিই মারা যাবেন নিরন্নের করাল গ্রাসে? নিশ্চয়ই নয়, তার সঙ্গে মরবেন পরিবারের অন্য সদস্যরা। যে সদস্যদের মধ্যে আছেন বৃদ্ধ পিতা। বয়সের ভারে ও দারিদ্রের কষাঘাতে পর্যুদস্ত মা’ও। পথ চেয়ে হা-ভাতে অন্ধকারে বসে থাকা স্ত্রী সন্তানেরা তো আছেনই।
যে অন্ধকার ঘরে থেকে কখনো কখনো ভাঙ্গা চালের ফাঁক দিয়ে দেখেন বিস্কুটের মতো গুড়া চাঁদ। যে চাঁদ লাবণ্যের প্রতীক নয় তাদের কাছে। সুকান্ত তাঁর সুবিখ্যাত কবিতা ‘হে মহাজীবন’ এ তো বলেই গেছেন, পেটে ক্ষুধা নিয়ে থাকা মানুষের কাছে পূর্ণিমার চাঁদ ঝলসানো রুটির মতো। আহা, এটি রুটি হলে ক্ষুধা নিবারণ হতো!
বিত্তবৈভব যাদের আছে, এইসব শ্রমজীবীর রক্তে-ঘামে যারা মিলিয়ন বিলিয়ন টাকার মালিক, যাদেরকে চাঁদের আলো প্রিয়তমার মুখ মনে করিয়ে দেয়, তাদের তো বোধোদয় হয়নি, হওয়ার সুযোগও নেই, তাদের আরও চাই, এর সঙ্গে যদি যুক্ত হয় রাষ্ট্রযন্ত্রের পৃষ্ঠপোষকতা-তাহলে তো কথাই নেই! অনিবার্য ভাবেই এই করোনার দুঃসহ কালে খেটে খাওয়া মানুষদের ঠেলে দেয়ার সুযোগ থাকে মৃত্যু ফাঁদে। শুধু কী শ্রমজীবীরা বেদনাদীর্ণ হৃদয়ে ঠোঁটে দাঁত চেপে সমর্পিত হওয়ার পথ তৈরি হচ্ছে মৃত্যু ফাঁদে? মোটেই না। তাতে নিশ্চিত ভাবেই ঝুঁকিতে পড়তে যাচ্ছেন কারখানার আশপাশের জনপদ।
ভেবে বিস্মিত হচ্ছি, একই সঙ্গে রাষ্ট্রযন্ত্র থেকে বাঁচার জন্য তাগিদ দেয়া হচ্ছে, অন্যদিকে মানবমারণাস্ত্র ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে। পঙ্গপালের মতো ঢুকছে মানুষ। হাজার হাজার মানুষের স্রোত ঢুকে পড়ছে বাঁধভাঙ্গা জোয়ারের মতো এ জেলায়। বাড়ছে উৎকণ্ঠা ও ঝুঁকি। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে নিশ্চিত ভাবেই একটি বড় বিপর্যয় দেখা দেবে শিগগিরিই। করোনার মতো অদৃশ্য মহাশক্তির সঙ্গে লড়াই করতে হবে লাখো লাখো মানুষকে। যে লড়াই হবে একতরফা। এ অসম লড়াইয়ে করোনারই জয় হওয়ার সুযোগ থাকছে বেশি।
এ দৃশ্যটিও দেখতে হচ্ছে, দেখে যেতে হবে।
করোনা সংকট নিয়ে বাংলাদেশের দৃশ্যপট সামনে রেখে এবার তাকানো যাক উন্নত বিশ্বের দিকে। কি দেখতে পাচ্ছি আমরা? পরাক্রমশালী আমেরিকার প্রেসিডেন্টের চোখে মুখে মৃত্যু-ভীতি, তাঁর মুখের পাণ্ডুরবর্ণ সুস্পষ্ট ইঙ্গিত দিচ্ছে ব্যর্থতা আর হতাশার ছায়া । নিউইয়র্কের মেয়রের চোখে জলের নাব্যতা। প্রচন্ড যুদ্ধের মাঠে মার খাওয়া সেনা প্রধানের মতো তিনি বাঁচার আকুতি জানিয়ে সাহায্য প্রার্থনা করছেন । একই অবস্থা ইতালী, ইংল্যান্ড, স্পেন, জার্মানী ও ফ্রান্সের রাষ্ট্র-নীতি নির্ধারকদের । এরাই তথ্য প্রযুক্তি ও চিকিৎসা বিজ্ঞানে অভূতপূর্ব সাফল্যকে পুঁজি করে বছরের পর বছর কোণঠাসা করে রেখেছে বাদ বাকি দুনিয়াকে। তারাই আজ চরম উৎকণ্ঠা নিয়ে মৃত্যুপুরীতে থেকে আলোর জন্য, আগামি ভোরের জন্য তাকিয়ে আছেন আকাশপানে। নক্ষত্রপানে তাকিয়ে বেদনার পানে তাকাচ্ছেন আর আশ্রয় প্রার্থনা করছেন দৈবশক্তির।
এমনকি যেখানে দীর্ঘ দুমাস তাদের নাগরিককে কোয়ারেন্টাইন এ রেখেও নিশ্চিত হতে পারছেন না মহাদুর্যোগ থেকে মুক্তির, পড়ছে লাশের পর লাশ, সেখানে আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্র পনেরো দিনের মাথায় হাজার হাজার লোককে ঘর থেকে বের করে এনে কারখনায় যোগদানের নির্দেশনা দিয়ে ফেলে দিচ্ছেন নিশ্চিত মৃত্যুর ঝুঁকিতে! তাদের সঙ্গে ঝুঁকিতে পড়তে যাচ্ছেন তাদের পরিবারের শিশু সন্তানসহ অন্যান্য সদস্যরা। আশপাশের লোকজন তো আছেই।
সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে বিপুল বেদনা নিয়ে বলতে হচ্ছে, এ এক বাঙলা, বিপজ্জনক বাঙলা!
বাঁচতে চাও, নিয়তির ওপর ভরসা করে বাঁচো, নিয়তি অনুমোদন না করলে মরো!