দোলায় চড়ে মর্ত্যে পা রাখলেন দূর্গতিনাশীনি মা দুর্গা
মৃণাল চৌধুরী সৈকত : সনাতন (হিন্দু) ধর্মে ও শাস্ত্র মতে এই বছর মা দুর্গার আগমন আর গমন অন্যান্য বছরের মতো নয়। অন্যান্য বছরের দুর্গা পুজার মতো ২০২০ সালের দুর্গা পুজার রেশ একই মেজাজে নেই! তবুও উমা ফিরবেন ঘরে, তাই বাঙ্গালী হিন্দু সম্প্রদায় বিশ্বজোড়া মহামারী কোভিড-১৯ করোনাকালীন সংকটের মধ্যেও ঘরের মেয়েকে যথাসাধ্য বরণ করে নিচ্ছে অনায়াসে। বিশ^ব্যাপী করোনা’র প্রবল দাপটের মধ্যে এবছর প্রতিটি পদক্ষেপেই রয়েছে মড়ক, মহামারীর ও প্রবল আশঙ্কা। ততাপিও বিশ^ হিন্দু সমাজ তথা সরকারের নীতি নির্ধারণের মধ্যেদিয়ে সর্তকতার সহিত পালন করা হচ্ছে শারদীয় দূর্গা পূজা। এ বছর দুর্গা পুজায় মা দূর্গা কিসে আসছেন, আর কিসে গমন করছেন, দূর্গা পূজা কি এবং কেন এসবের মাহাত্ব নিয়েই আজকের এ লেখাটি।
শাস্ত্র তথা পঞ্জিকা মতে, ২০২০ সালে মা দুর্গার মর্ত্যে আগমন দোলায়। এবারের পুজায় মা দুর্গা আসছেন দোলায় চড়ে। ফলে প্রবল মড়ক পুজার সময় পর্যন্ত চলবে বলে দাবী হিন্দু শাস্ত্রীয় দেশী-বিদেশী বিশেষজ্ঞদের। পুজার আগ মূহুর্ত পর্যন্ত প্রবল মহামারী পরিস্থিতি থেকে যাওয়ার সম্ভবনাও রয়েছে। শাস্ত্র মতে : এবার দুর্গা মায়ের গমন গজে। অর্থাৎ ধীর, শান্ত হাতিতে চড়ে মা দূর্গা এবার পাড়ি দেবেন স্বর্গে। এরও একটি বিশেষ ফল রয়েছে। শাস্ত্র মতে, গজে চড়ে মা দূর্গার গমন শুভ। এর ফলে বিশ্বে শুভ কোনও বার্তা নেমে আসবে। গজে গমনে সাধারণত শস্য-শ্যামলা বসুন্ধরা হয়। এবার তারই প্রভাব পড়বে বিশ্বে এমনটাই মনে করছেন ধর্মগুরুরা।
দূর্গা পূজা কি এবং কেন ? হিন্দু সম্প্রদায়ের দুর্গা পূজা বা দুর্গোৎসব হল দেবী দুর্গার পূজাকে কেন্দ্র করে প্রচলিত একটি উৎসব। দুর্গা পূজা সমগ্র হিন্দু সমাজে যুগ-যুগান্তর ধরে প্রচলিত। তবে বাঙ্গালী হিন্দু সমাজে এটি অন্যতম ও বিশেষ ধর্মীয় ও সামাজিক একটি উৎসব। আশ্বিন বা চৈত্র মাসের শুক্ল পক্ষে দুর্গা পূজা করা হয়। আশ্বিন মাসের দুর্গা পূজা শারদীয়া দুর্গা পূজা এবং চৈত্র মাসের দুর্গা পূজা বাসন্তী পূজা নামে পরিচিত। শারদীয়া দুর্গা পূজার জনপ্রিয়তা সবচেয়ে বেশি আর বাসন্তী পূজা মূলত কয়েকটি পরিবার বা এলাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ। বাসন্তী পূজা বসন্তকালীন দুর্গা পূজা। বসন্তকালীন দূর্গা পূজা পালনকারী হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক হিন্দু উৎসব। বাংলাদেশের গুটি কয়েক পরিবার, পাড়া-মহল্লা বা বিশেষ কিছু এলাকায় আর ভারতের ওড়িষ্যা, মৈথিলী ও অসমীয়া (আসামে’র) অন্যতম প্রধান ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক উৎসব এটি। হিন্দু সম্প্রদায়ের শারদীয়া উৎসবে পারিবারিক ও অন্যান্য সামাজিক সম্মিলন, কেনাকাটা ও উপহার প্রদান,শুভেচ্ছা বিনিময়সহ উপবাস, মন্ডপ দর্শন, আলোকসজ্জা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, প্রতিমা বিসর্জন ইত্যাদির রেওয়াজ রয়েছে।
মা দুর্গার শাস্ত্রবিহিত পূজানুষ্ঠান শুরু হয় দুর্গাষষ্ঠী কল্পারম্ভ পূজা বোধন, আমন্ত্রণ ও অধিবাসের মধ্যদিয়ে। তারপর মহাসপ্তমী: ক্ষেত্রবিশেষে কুলাচার অনুসারে সপ্তম্যাদি কল্পারম্ভ নবপত্রিকা স্নান, প্রবেশ ও স্থাপন মহাসপ্তমীবিহিত পূজা। মহাষ্টমী: ক্ষেত্রবিশেষে কুলাচার অনুসারে অষ্টম্যাদি কল্পারম্ভ অথবা কেবল কল্পারম্ভ মহাষ্টমীবিহিত পূজা, দুর্গাষ্টমী ব্রত, বীরাষ্টমী ব্রত, কুমারী পূজা, অধরাত্রবিহিত পূজা, মহাপূজা মহোৎসব যাত্রা (তান্ত্রিক অনুষ্ঠান), সন্ধিপূজা ও বলিদান। মহানবমী: কেবল মহানবমীকল্পারম্ভ মহানবমী বিহিত পূজা, ক্ষেত্রবিশেষে কুমারী পূজা করা হয়। বিজয়াদশমী: বিজয়াদশমীবিহিত বিসর্জনাঙ্গ পূজা, সিঁদুর খেলা, মিষ্টি মুখ, বিসর্জন, বিজয়াদশমী কৃত্য ও কুলাচারানুসারে বিসর্জনান্তে অপরাজিতা পূজার মধ্যদিয়ে শেষ হয়।
দুর্গা পূজা বা দুর্গোৎসব হল হিন্দু দেবী দুর্গা মায়ের পূজাকে কেন্দ্র করে হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচলিত একটি উৎসব। দুর্গা পূজা সমগ্র হিন্দু সমাজেই প্রচলিত। তবে বাঙ্গালী হিন্দু সমাজে এটি অন্যতম বিশেষ ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসব বটে। আশ্বিন বা চৈত্র মাসের শুক্ল পক্ষে দুর্গা পূজা করা হয়। আশ্বিন মাসের দুর্গা পূজা, মা দূর্গার অকাল বোধন বা শারদীয়া দুর্গা পূজা এবং চৈত্র মাসের দুর্গা পূজা, বাসন্তী পূজা বা বাসন্তী দূর্গা পূজা নামে পরিচিত।
২০২০ সালের দুর্গা পুজার অন্যতম বিশেষত্ব হল, মহালয়ার ৩৫ দিন পর মা দুর্গা মর্ত্যে পা রেখেছেন। আর সেই মতে, ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ১৭ তারিখ হয়ে গেলো মহালয়া। ২০২০ সালের দুর্গা পুজা ২১ অক্টোবর মহাপঞ্চমী পূজার মধ্যদিয়ে শুরু। তার ঠিক ৩৫দিন আগে হয়ে গেছে মহালয়া। ফলে মহালয়া থেকে লম্বা আমেজ শুরু হয়েছে এবারের দূর্গা পুজার। ২০২০ সালের দুর্গা পুজা আশ্বিন নয়, কার্তিক মাসে হচ্ছে। সাধারণত আশ্বিন মাসের শুক্ল পক্ষের ষষ্ঠ থেকে দশম দিন পর্যন্ত শারদীয়া দুর্গা পূজা অনুষ্ঠিত হয়। এই পাঁচ দিন যথাক্রমে “দুর্গাষষ্ঠী”, “মহাসপ্তমী”, “মহাষ্টমী”, “মহানবমী” ও “বিজয়াদশমী” নামে পরিচিত। আশ্বিন মাসের শুক্ল পক্ষটিকে বলা হয় “দেবীপক্ষ”। দেবীপক্ষের সূচনার অমাবস্যাটির নাম মহালয়া। এই দিন হিন্দুরা তাদের পূর্ব পুরুষদের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করেন। দেবীপক্ষের শেষ দিনটি হল কোজাগরী পূর্ণিমা। এই দিন দেবী লক্ষ্মীর পূজা করা হয়। কোথাও কোথাও পনেরো দিন ধরে দুর্গা পূজা পালিত হয়। সে ক্ষেত্রে মহালয়ার আগের নবমী তিথিতে পূজা শুরু হয়।
আমার জানা মতে, পশ্চিমবঙ্গের বিষ্ণুপুর শহরের মৃন্ময়ী মন্দির এবং ওই অঞ্চলের অনেক পরিবারে এই রীতি এখনো প্রচলিত আছে। বাংলাদেশে বিজয়াদশমীতে সর্ব সাধারণের জন্য এক দিন এবং হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের জন্য সরকারী ভাবে ৩ দিন ছুটি থাকে। তথ্যমতে, ভারতে দুর্গা পূজা প্রধানত পারিবারিক স্তরে ধনী পরিবারগুলোতে আয়োজন করা হয়ে থাকে, সার্বজনিন ভাবে সংখ্যায় কম। তবে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশী সার্বজনিন ভাবে আয়োজন করা হয়। ভারতের কলকাতা শহরের পুরনো ধনী পরিবারগুলির দুর্গা পূজা “বনেদি বাড়ির পূজা” নামে পরিচিত। পারিবারিক দুর্গা পূজাগুলিতে শাস্ত্রাচার পালনের উপরেই বেশি জোর দেয়া হয়ে থাকে। দূর্গা পূজা উপলক্ষে বাংলাদেশ বা ভারতে প্রতিটি বাড়িতেই আত্মীয়-স্বজনের সমাগম হয়ে থাকে। অন্যদিকে আঞ্চলিক স্তরে এক একটি অঞ্চল, পাড়া, মহল্লা, গ্রাম ও শহরের বাসিন্দারা যৌথভাবে যে দুর্গা পূজার আয়োজন করেন তা বারোয়ারি বা সার্বজনীন পূজা নামে পরিচিত। ভারতে ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনের সময় সার্বজনীন পূজা শুরু হয়। মুলত দেবী মা দুর্গাকে মাথায় রেখেই দেশমাতা বা ভারত মাতা বা মাতৃভূমির জাতীয়তাবাদী ধারনা, বিপ্লবে রুপ নেয় ভারতীয়দের মধ্যে। দেবী দুর্গার ভাবনা থেকেই বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ‘বন্দে মাতরম’ গানটি রচনা করেন যা ভারতের স্বাধীনতা-আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্র। সুভাষ চন্দ্র বসুসহ বিপ্লবী ও জাতীয়তাবাদী তৎকালীন নেতারা বিভিন্ন সার্বজনীন পূজার সঙ্গে যুক্ত থাকতেন বলেও যথেষ্ট তথ্য প্রমাণ রয়েছে। এখনকার সার্বজনীন পূজায় নির্দিষ্ট বিষয়ভিত্তিক মন্ডপ, মায়ের প্রতিমা প্রতিযোগীতা ও আলোকসজ্জার প্রবণতা দেখা যায়।
এবার আসা যাক, দূর্গা পূজা কি এবং কেনো করা হয় ? শারদীয়া দুর্গা পূজাকে “অকাল বোধন” বলা হয়। তথ্য মতে, কালিকা পুরাণ ও বৃহদ্ধর্ম পুরাণ অনুসারে, রাম ও রাবণের যুদ্ধের সময় (শরৎকালে) মা দুর্গা’র পূজা করা হয়েছিল। হিন্দু শাস্ত্রানুসারে, শরৎকালে দেবতারা ঘুমিয়ে থাকেন। তাই এই সময়টি তাদের পূজা অর্চনার যথাযথ সময় নয়। অকালে মা দূর্গার পূজা করার কারণে এই পূজার নাম হয় “অকাল বোধন”। উপরোক্ত দুই পুরাণ অনুসারে, রামকে সাহায্য করার জন্য ব্রহ্মা দুর্গার বোধন ও পূজা করেছিলেন। কৃত্তিবাস ওঝা তার রামায়ণে লিখেছেন, রাম স্বয়ং দুর্গার বোধন ও পূজা করেছিলেন। তবে রামায়ণের প্রকৃত রচয়িতা বাল্মীকি মুনি রামায়ণে রামচন্দ্রকৃত দুর্গা পূজার কোনো উল্লেখ করেন-নি। উপরন্তু রামায়ণের অন্যান্য অনুবাদেও এর কোনো উল্লেখ পাওয়া যায় না। তবে হিন্দু শাস্ত্রীয় (প্রচলিত) তথ্য অনুসাওে, স্মৃতিশাস্ত্র সমূহে শরৎকালে দুর্গা পূজার বিধান দেয়া হয়েছে। হংস নারায়ণ ভট্টাচার্যের মতে, মা দূর্গার “অকাল বোধন” শরতে বৈদিক যজ্ঞের আধুনিক রূপায়ণ ছাড়া আর কিছুই না। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ-এ কৃষ্ণকে দুর্গা পূজার প্রবর্তক বলা হয়েছে। বিভিন্ন দেব-দেবীরা কি ভাবে দুর্গা পূজা করেছিলেন, তার একটি তালিকা এই পুরাণে পাওয়া যায়। তবে এই প্রসঙ্গে কোনো পৈৗরাণিক গল্পের বিস্তারিত বর্ণনা এই পুরাণে দেওয়া হয়নি। বলা হয়েছে: প্রথমে পূজিতা সাচৈ কৃষ্ণেন পরমাত্মনা। অর্থাৎ, সৃষ্টির প্রথম যুগে পরমাত্মা কৃষ্ণ বৈকুণ্ঠের আদি-বৃন্দাবনে প্রথম দুর্গাপূজা করেন। এরপর মধু ও কৈটভ নামে দুই অসুরের ভয়ে ব্রহ্মা দ্বিতীয় দুর্গা পূজা করেছিলেন। ত্রিপুর নামে এক অসুরের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে শিব বিপদে পড়ে তৃতীয় দুর্গা পূজার আয়োজন করেন। দুর্বাসা মুনির অভিশাপে লক্ষ্মীকে হারিয়ে ইন্দ্র যে পূজার আয়োজন করেছিলেন, সেটিও ছিল চতুর্থ দুর্গাপূজা। এরপর থেকেই পৃথিবীতে মুনি-ঋষি, সিদ্ধ-পুরুষ, দেবতা এবং মানুষেরা নানা দেশে নানা সময়ে দুর্গা পূজা করে আসছেন। এছাড়াও শাক্তধর্মের অন্যতম প্রধান ধর্মগ্রন্থ ‘দেবীভাগবত পুরাণ’ অনুসারে, ব্রহ্মার মানসপুত্র মনু পৃথিবীর শাসক হয়ে ক্ষীরোদ সাগরের তীরে মাটি দিয়ে “মা দুর্গা’র” মূর্তি তৈরি করে পূজা করেন। ওই সময় তিনি “ভাগ্ভবত” বীজ জপ করেন এবং আহার ও শ্বাস গ্রহণ ত্যাগ করে এক পায়ে দাড়িয়ে একশ বছর ঘোর তপস্যা করেন। ফলে তিনি শীর্ণ হয়ে পড়েন, এতে করে তিনি কাম ও ক্রোধ জয় করতে সক্ষম হন এবং দুর্গানাম চিন্তা করতে করতে সমাধির প্রভাবে স্থাবরে পরিণত হন। তখন দেবী দুর্গা প্রীত হয়ে তাকে বর দিতে আসেন। মনু তখন দেবতাদেরও দুর্লভ একটি বর চাইলেন। দেবী দুর্গা মনু’র সেই প্রার্থনা রক্ষা করেন। সেই সঙ্গে দুর্গা তার রাজ্য শাসনের পথ নিষ্কণ্টক করেন এবং মনুকে পুত্র লাভের বর দেন।
বৈষ্ণবী ও বারাহী দেবী শুম্ভ-নিশুম্ভের অসুর সৈন্যের সঙ্গে যুদ্ধরতা, সপ্তদশ শতাব্দীর পুথিচিত্রণ মূল নিবন্ধ শ্রীশ্রীচন্ডী থেকে জানা যায়, দুর্গা ও দুর্গা পূজাকে কেন্দ্র করে যতগুলি পৌরাণিক গল্প প্রচলিত রয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় গল্পটি পাওয়া যায় শ্রীশ্রীচন্ডী বা দেবীমাহাত্ম্যম্-এ। এই গল্পটি হিন্দু সম্প্রদায় এতটাই মান্য করে যে শ্রীশ্রীচন্ডী’র পাঠ দুর্গা পূজার একটি অপরিহার্য অঙ্গ হয়ে যায়। দেবী মাহাত্ম্যম্ আসলে মার্কয়ে পুরাণ-এর একটি নির্বাচিত অংশ। এতে তেরটি অধ্যায়য়ে মোট সাতশ শ্লোক রয়েছে। এই গ্রন্থে দেবী দুর্গাকে নিয়ে প্রচলিত তিনটি গল্প ও দুর্গা পূজা প্রচলনের একটি গল্প রয়েছে। প্রতিটি গল্পে দেবী দুর্গাই কেন্দ্রীয় চরিত্র।
রাজা সুরথের গল্প অনুসারে, রাজা সুরথের গল্পটি শ্রীশ্রীচন্ডী’র প্রধান তিনটি গল্পের অবতরণিকা ও যোগসূত্র। সুরথ ছিলেন পৃথিবীর রাজা। সুশাসক ও যোদ্ধা হিসেবে তার যথেষ্ট খ্যাতি ছিল। কিন্তু একবার এক যুদ্ধে এক যবন জাতির হাতে তার পরাজয় ঘটে। সেই সুযোগে তার মন্ত্রী ও সভাসদবৃন্দ ও স্ত্রী সন্তানরা তার ধন-সম্পদ ও সেনাবাহিনীর দখল নেন। সুরথ মনের দুঃখে বনে চলে আসেন। বনের মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে তিনি মেধা নামে এক ঋষির আশ্রমে এসে উপস্থিত হন। মেধা ঋষি, রাজা সুরথকে সমাদর করে নিজের আশ্রমে আশ্রয় দেন। কিন্তু বনে থেকেও রাজার মনে সুখ ছিল না। সব সময় তিনি তার হারানো রাজ্যের ভাল-মন্দের কথা ভেবে শঙ্কিত হতে থাকেন। একদিন বনের মধ্যে রাজা সুরথ, সমাধি নামে এক বৈশ্যের দেখা পেলেন। তার সঙ্গে কথা বলে রাজা সুরথ জানতে পারলেন, সমাধির স্ত্রী ও ছেলেরা তার সব টাকা পয়সা ও বিষয় সম্পত্তি কেড়ে নিয়ে তাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু তাও তিনি সব সময় নিজের স্ত্রী ও সন্তান ও মন্ত্রী সভাসদ বৃন্দের কল্যাণ-অকল্যাণের কথা চিন্তা করে শঙ্কিত হতেন। একদিন তার মনে প্রশ্ন জাগল, যারা তার সব কিছু কেড়ে নিয়েছে, তাদের প্রতি তার রাগ হচ্ছে না কেন ? কেনই বা তিনি সেই সব লোকেদের ভাল-মন্দের কথা চিন্তা করে করে শঙ্কিত হচ্ছেন ? রাজা সুরথ, ঋষি মেধাকে এই বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ঋষি বললেন, পরমেশ্বরী মহামায়ার প্রভাবেই এমনটা হচ্ছে। রাজা সুরথ তাকে মহামায়ার কথা জিজ্ঞাসা করলে, তিনি একে একে তাকে তিনটি গল্প বলেন। ওই গল্পগুলিই শ্রীশ্রীচন্ডি’র মূল আলোচ্য বিষয়। গ্রন্থটির শেষাংশে দেখা যায়, মেধার গল্প শুনে, রাজা সুরথ ও সমাধি মিলে নদীর তীরে তিন বছর কঠিন তপস্যা ও দুর্গা পূজা করলেন এবং শেষে দেবী দুর্গা তাদের দেখা দিয়ে রাজা সুরথকে তার হারানো রাজ্য ফিরিয়ে দিলেন এবং বৈশ্যকে তত্ত্বজ্ঞান দিলেন।
মধু কৈটভের কাহিনী: শ্রীশ্রীচন্ডি গ্রন্থের প্রথম অধ্যায়ে সংক্ষেপে মধু কৈটভের উপাখ্যানটি বর্ণিত রয়েছে : এক বিরাট প্রলয়কালে পৃথিবী মহা-সমুদ্রে পরিণত হয়। ভগবান বিষ্ণু সেই সমুদ্রের উপর অনন্ত নাগকে শয্যা করে যোগনিদ্রায় মগ্ন হলেন। ওই সময় বিষ্ণুর কর্ণমল থেকে মধু ও কৈটভ নামে দুই দৈত্য নির্গত হয়ে ভগবান বিষ্ণু’র নাভি পদ্মে স্থিত ব্রহ্মাকে বধ করতে উদ্যত হলেন। ভীত হয়ে ব্রহ্মা, বিষ্ণুকে জাগ্রত করার জন্য তার নয়নাশ্রিতা যোগনিদ্রার স্তব করতে লাগলেন। এই স্তবটি ওই গ্রন্থে উল্লিখিত চারটি প্রধান স্তব-মন্ত্রের অন্যতম। এই স্তবে সন্তুষ্টা দেবী বিষ্ণুকে জাগ্রত করার পর তিনি পাঁচ হাজার বছর ধরে মধু ও কৈটভের সঙ্গে মহা-সংগ্রামে রত হলেন। মহামায়া শেষে ঐ দুই অসুরকে বিমোহিত করলেন। দৈত্যদ্বয় ভগবান বিষ্ণুকে বললেন, “আপনার সঙ্গে যুদ্ধ করে আমরা প্রীত; তাই আপনার হাতে মৃত্যু হবে আমাদের। তবে, পৃথিবীর যে স্থান জলপ্রবাবিত নয়, সেখানে-আপনি আমাদের উভয়কে বিনাশ করতে পারেন। বিষ্ণু বললেন, “তথাস্তু” এবং দৈত্যদ্বয়ের মাথা নিজের জঙ্গার উপর রেখে তাদের বধ করলেন। এবার আসা যাক, মহিষাসুরের কাহিনীতে : মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গা, শ্রীশ্রীচন্ডি গ্রন্থে বর্ণিত দেবী দুর্গার কাহিনীগুলির মধ্যে সর্বাধিক জনপ্রিয় আবার এ গ্রন্থের মধ্যম চরিত্র বা দ্বিতীয় খন্ডে উল্লিখিত মহিষাসুর বধের কাহিনিটি। এই কাহিনি অনুসারে : পুরাকালে মহিষাসুর দেবগণকে একশত বর্ষ-ব্যাপী এক যুদ্ধে পরাস্ত করে স্বর্গের অধিকার কেড়ে নিলে, বিতাড়িত দেবগণ প্রথমে প্রজাপতি ব্রহ্মা এবং পরে তাকে মুখপাত্র করে শিব ও নারায়ণের সমীপে উপস্থিত হলেন। মহিষাসুরের অত্যাচার কাহিনী শ্রবণ করে তারা উভয়েই অত্যন্ত ক্রোধান্বিত হলেন। সেই ক্রোধে তাদের মুখমন্ডল ভীষণাকার ধারণ করল। প্রথমে বিষ্ণু ও পরে শিব ও ব্রহ্মার মুখমন্ডল হতে এক মহাতেজ নির্গত হল। সেই সঙ্গে ইন্দ্রাদি অন্যান্য দেবতাদের দেহ থেকেও সু-বিপুল তেজ নির্গত হয়ে সেই মহাতেজের সঙ্গে মিলিত হল। অত:পর, সু-উচ্চ হিমালয়ে স্থিত ঋষি কাত্যায়নের আশ্রমে সেই বিরাট তেজঃপুঞ্জ একত্রিত হয়ে এক নারী মূর্তি ধারণ করল। কাত্যায়নের আশ্রমে আবির্ভূত হওয়ায় এই দেবী, কাত্যায়নী নামে অভিহিত হলেন। এই দেবী ছিলেন, দেবী পার্বতীর অবতার। আশ্বিন মাসের কৃষ্ণা চতুর্দশী তিথিতে দেবী কাত্যায়নী আবির্ভূত হয়েছিলেন। শুক্লা সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমী তিথিতে কাত্যায়নী দেবীকে পূজা করেন এবং দশমীতে দেবী মহিষাসুর বধ করেন।
যাই হোক, এক এক দেবতার প্রভাবে দেবীর এক এক অঙ্গ উৎপন্ন হল। প্রত্যেক দেবতা তাদের আয়ূধ বা অস্ত্র দেবীকে দান করলেন। হিমালয় দেবীকে তার বাহন সিংহ দান করলেন। এই দেবী-ই অষ্টাদশভূজা মহালক্ষ্মী রূপে মহিষাসুর বধের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন (শ্রীশ্রীচন্ডি অনুসারে, মহালক্ষ্মী দেবী মহিষাসুর বধ করেন। ইনিই দুর্গা। তবে সনাতনী হিন্দু সম্প্রদায় এঁকে দশভূজারূপে পূজা করে থাকেন)। দেবী ও তার বাহনের সিংহনাদে ত্রিভুবন কম্পিত হতে লাগল। মহিষাসুর সেই প্র-কম্পনে ভীত হয়ে প্রথমে তার সেনাদলের বীরযোদ্ধাদের পাঠাতে শুরু করলেন। দেবী ও তার বাহন সিংহ প্রবল পরাক্রমে যুদ্ধ করে একে একে সকল যোদ্ধা ও অসুর সেনাকে বিনষ্ট করলেন। তখন মহিষাসুর স্বয়ং নিজে দেবীর সঙ্গে যুদ্ধ শুরু করলেন। যুদ্ধকালে ঐন্দ্রজালিক মহিষাসুর নানা রূপ ধারণ করে দেবীকে ভীত বা বিমোহিত করার প্রচেষ্টায় রত হলেন। কিন্তু দেবী, সেই সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দিলেন। তখন অসুর অহঙ্কারে মত্ত হয়ে প্রবল গর্জন করলেন। দেবী বললেন, যতক্ষণ আমি মধুপান করি, ততক্ষণ তুই গর্জন করে-নে। আমি তোকে বধ করলে-ই দেবতারা এখানে গর্জন করবেন।
এই বলে দেবী লম্ফ দিয়ে মহিষাসুরের উপর চড়ে, তার কণ্ঠে পা দিয়ে ত্রিশূলদ্বারা বক্ষ বিদীর্ণ করে তাকে বধ করলেন। অসুরসেনা হাহাকার করতে করতে পলায়ন করলেন এবং দেবতারা স্বর্গের অধিকার ফিরে পেয়ে আনন্দধ্বনি করতে লাগলেন।
অবশেষে, যদিও কোভিড-১৯ করোনা মহামারি পরিস্থিতির কারণে এবার দুর্গা পূজায় বড় ধরণের উৎসব হবে না। স্বাস্থ্যবিধি মেনে স্বাত্ত্বিক আচারের মাধ্যমে পূজার আয়োজন সীমাবদ্ধ রাখা হবে। ঢাকায় হবে না কুমারী পূজাও। মন্দির বন্ধ হয়ে যাবে রাত নয়টার মধ্যে। জন-সমাগম পরিহার করতে মন্দির কর্তৃপক্ষ প্রসাদ বিতরণ থেকেও বিরত থাকবেন। হবে না বিজয়ার শোভাযাত্রা। তবে করোনা পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ লাভের জন্য মন্দিরে মন্দিরে বিশেষ প্রার্থনা করা হবে। বাংলাদেশ পূজা উদ্যাপন পরিষদের নেতারা এ কথা বাংলাদেশ সরকারসহ দেশব্যাপী পূজা উদ্যাপন পরিষদের নেতাদের জানিয়ে দিয়েছেন ইতিমধ্যে। কোভিড-১৯ করোনা পরিস্থিতির কারণে এবার পূজায় উৎসবের আয়োজন থাকছে না প্রতিবারের মতো। এজন্য মন্দিরে আলোকসজ্জা, বিশেষ সাজসজ্জা, মেলা, আরতি প্রতিযোগিতা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিহার করা হচ্ছে। ভক্তিমূলক গান ছাড়া অন্য কোনো রকম গান বাজানো যাবে না। কোনো আতশবাজি বা পটকার ব্যবহার করা যাবে না। তা ছাড়া এবার জন-সমাগম পরিহার করতে প্রতিটি মন্দির কর্তৃপক্ষ প্রসাদ বিতরণ ে থেকেও বিরত থাকবে। সন্ধ্যার মধ্যেই আরতি সম্পন্ন করা হবে। রাত নয়টার পর মন্দির বন্ধ করে দেয়া হবে। মন্দিরে প্রবেশ শিথিল করে দেয়া হবে দর্শনার্থীদের। প্রতিটি মন্দিরে নারী ও পুরুষের জন্য আলাদা প্রবেশের ব্যবস্থা থাকবে। থাকবে সিসি ক্যামেরা, আইনশৃংখলা বাহিনীর নিয়মিত টহলসহ সরকারী তত্বাবধানে মন্দির পরিচালনা কমিটি ও পূজা উদ্যাপন পরিষদের নিজ নিজ ব্যবস্থাপনায় থাকবে বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা। সামাজিক দূরত্ব মেনে, মাস্ক ব্যবহার করে ভক্তরা অঞ্জলি দিতে পারবেন। বিজয়া দশমী হবে ২৬ অক্টোবর, তবে এবার বিজয়ার শোভাযাত্রা হবে না। মন্দিরগুলো তাদের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় প্রতিমা বিসর্জনের ব্যবস্থা করবে।
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, এবছর সারা দেশে মোট ৩০ হাজার ২৩১টি পূজা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। গত বছর পূজা হয়েছিল ৩১ হাজার ৩৯১টি। এবার ১ হাজার ১৮৫টি পূজা কম হচ্ছে। মহামারী করোনা পরিস্থিতির কারণে পূজার সংখ্যা কমেছে বলে মনে করছেন অনেকেই।
এদিকে গাজীপুর মহানগরের ৮টি থানায় এলাকায় মোট ৮৭ টি পূজা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। তার মধ্যে টঙ্গী পূর্ব থানায় ৬টি, পশ্চিম থানায় ২টি, পূবাইল থানায় ৯টি, গাছা থানায় ১৩টি, বাসন থানায় ৯টি, সদর থানায় ৩০টি, কাশিমপুর থানায় ১৩টি, কোনাবাড়ি থানায় ৫টি । প্রতিটি থানা এলাকায় গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ, র্যাবসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে ব্যাপক নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহন করা হয়েছে। কোভিড-১৯ করোনা মহামারি পরিস্থিতি মোকাবেলা করে দেশ ও জাতির কল্যাণার্থে শান্তিপূর্ণ ভাবে শারদীয়া দূর্গা পূজা শুরু ও পরি-সমাপ্তি ঘটবে এ প্রত্যাশা সকলের।